রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শুক্রবার রাত ১টার দিকে মৃত্যু হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
প্রায় ৯ দশকের এ জীবনে অনেক কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন মুহিত। তিনি উত্তরসূরিদের জন্য রেখে গেছেন কর্মোজ্জ্বল এক অধ্যায়, যা তাকে করে রাখবে স্মরণীয়।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন ভারতের সিলেট শহরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অ্যাডভোকেট আবদুল হাফিজ এবং মা সমাজকর্মী সৈয়দা শাহার বানু।
এ দম্পতির ১১ সন্তানের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন তৃতীয়। মা-বাবা আদর করে তার ডাকনাম রাখেন শিশু।
শিক্ষাজীবন
মুহিতের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার মা সৈয়দা শাহার বানুর কাছে। পরে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী দুর্গা কুমার পাঠশালায় প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। ক্লাসে প্রতিনিয়তই প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা শুরু হয় তখন থেকেই।
ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের আমলে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। ঐতিহ্যবাহী এ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ১৯৪১-১৯৪৯ মেয়াদের শিক্ষার্থী ছিলেন মুহিত।
সে স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি।
স্কুলজীবনে মুহিত স্কাউটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন স্কাউট সমাবেশে তিনি অংশ নিতেন।
এ এম এ মুহিত ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ ও প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৫৪ সালে ইংরেজি বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। পরে এমএ পরীক্ষায় ১৯৫৫ সালে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে মুহিত এসএম হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন।
ছাত্রজীবনে বক্তৃতা, বিতর্ক ও রচনা প্রতিযোগিতায় তিনি বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
কর্মজীবন
এ এম এ মুহিত ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে লাহোরে সিভিল সার্ভিস অ্যাকাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।
মহকুমা হাকিম (এসডিও) হিসেবে তার প্রথম কর্মস্থল ছিল বর্তমান পাকিস্তানের মুলতান। পরবর্তী সময়ে তিনি কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৭-১৯৫৮ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি অর্জন করেন মুহিত। তা ছাড়া ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
১৯৬০-১৯৬৯ সালে মুহিত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৬ সালে তিনি সরকারের তমগা-এ-খেদমত খেতাবে ভূষিত হন।
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা কমিশন প্রধান ও ডেপুটি সেক্রেটারি থাকাকালীন তিনি সাহসিকতার সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে প্রতিবেদন দেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
১৯৬৯ সালে এ এম এ মুহিত যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর পদে যোগ দেন। তখন শুরু হয় গণ-অভ্যুত্থান।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ও পাকিস্তানিদের বৈরিতা মুহিতকে ব্যথিত করে তোলে। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুহিতই প্রথম পাকিস্তানি কূটনীতিক যিনি বাংলাদেশের পক্ষে পাকিস্তানের কূটনৈতিক দায়িত্ব ত্যাগ করেন। দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পরিক্ল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে।
সরকারি চাকরি থেকে অবসর
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভাবনা এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি নিয়ে শুরু হয় মুহিতের জীবনের নতুন যাত্রা। তিনি ১৯৮১ সালে সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেন।
মুহিত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইডিবির মতো সংস্থাগুলোতে কাজ করেন। তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ করে নন্দিত হন।
১৯৮২-১৯৮৩ সালে সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন মুহিত। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৫ সালে তিনি তৎকালীন সরকার থেকে অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ফেলো হিসেবে অধ্যাপনা করেন। পরবর্তী সময়ে নিজ জেলাকে ‘আলোকিত সিলেট’-এ রূপান্তরের স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি।
আওয়ামী লীগে যোগদান
এ এম এ মুহিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার স্বপ্ন ধারণ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে অংশ নেন।
নির্বাচনে জয়ী না হলেও তিনি ‘আলোকিত সিলেট’ গড়ার লক্ষ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে থাকেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি সিলেট-১ আসনের এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
২০১৯ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি সর্বাধিক ১২টি বাজেট প্রণয়ন করেন।
১০ বছর অর্থমন্ত্রী থাকাকালে এ এম এ মুহিত পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, বড় বড় নগরীতে ফ্লাইওভার, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ ৪ লেন হাইওয়ে, কর্ণফুলীতে বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, দেশব্যাপী বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বাস্তবায়নের মতো বৃহদাকার প্রকল্পগুলো নিয়ে কাজ করেছেন।
সিলেটের উন্নয়ন
এ এম এ মুহিত আলোকিত সিলেট শহরকে ডিজিটাল, আধুনিক, পর্যটন ও প্রবাসীবান্ধব নগরী গড়ার জন্য অর্থায়নসহ পরিশ্রম করে গেছেন।
ঢাকা-সিলেট ৪ লেন প্রকল্প, শেরপুরে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, শ্রীমঙ্গলে চা-নিলাম কেন্দ্র স্থাপন, সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের উপযোগীকরণ, সিলেট কেন্দ্রীয় জেল নতুন জায়গায় স্থানান্তর, সিলেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি প্রকল্প গ্রহণ তার বিশেষ অবদান।
সিলেট শহরকে উন্নত নগরীতে রূপায়নের জন্য তিনি দল-মতনির্বিশেষে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
সংস্কৃতি ও সাহিত্যে বিচরণ
সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো ছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সিলেটের মরমি কবি হাছন রাজা, রাধারমন দত্ত, সৈয়দ শাহনূর ও শাহ আব্দুল করিমের ভক্ত তিনি।
মুহিত সিলেটে আয়োজন করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট আগমনের শতবার্ষিকী। তার সব রচনাবলি বেরিয়েছে দশটি বৃহৎ খণ্ডে।
এ এম এ মুহিতের লাইব্রেরি বর্তমানে অন্যতম বৃহৎ ব্যক্তিগত লাইব্রেরি।
সামাজিক কার্যক্রম
এ এম এ মুহিত সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবনে ভলান্টিয়ার হিসেবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেছেন।
চাকরিকাল থেকে অবসর নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রীতির বন্ধন বৃদ্ধিকল্পে ভারতে সর্বভারতীয় শ্রীহট্ট সম্মিলনী ও জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা, প্রধান অতিথি হিসেবে তাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন বিভিন্ন সম্মেলনে। এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনসহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন তিনি।
পুরস্কার
মুহিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়েছে।