সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের একপাশে সুরমা নদী, আরেক পাশে শনির হাওর। নদীর ঠিক তীর ঘেঁষে লম্বা সড়কের মতো এক জায়গায় কয়েকটি ঘর নিয়ে একটি গ্রাম।
গ্রামের নাম উজ্জ্বলপুর। নাম যদিও উজ্জ্বলপুর, তবে এখানে উজ্জ্বলতার চিহ্নমাত্র নেই। বরং দারিদ্র্য আর মলিনতার ছাপ সবখানে।
গ্রামে ঘর আছে ৪৫টি। এর মধ্যে দুটি মাত্র সেমি পাকা। বাকি সবই মাটির। অবশ্য এই ঘরগুলো এখন আর নেই। মঙ্গলবার মধ্যরাতের ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে গ্রামের ৪৩টি ঘরই। ফলে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন গ্রামের বাসিন্দারা।
হাওরের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বুধবার বিকেলে উজ্জ্বলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঝড়ে একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা পুরো গ্রামটির। গ্রামের একেকটা বাড়ি ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে পাশের নদীতে। কোনোটা আবার উড়ে গিয়ে পড়েছে হাওরে। কারও কারও ঘরের চালা-বেড়া খুঁজেই পাওয়া যায়নি।
বাড়ির উড়ে যাওয়া টিন ও বেড়া খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। কাজের ফাঁকেই আক্ষেপ করে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঢলে ধান নিয়ে গেছে, এইবার ঝড়ে ঘরও চলে গেল। এখন আমরা খাব কী আর থাকব কোথায়? খাওয়া-থাকা দুই নিয়েই এখন অনিশ্চয়তা।’
ঝড়ের সময় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন মোসলেম উদ্দিন। ঝড়ের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঝড় শুরু হওয়ার পর ঘরের টিন উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমরা সবাই খাটের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিই। এরপর ঘরের বেড়া উড়ে যায়। খাটও উড়িয়ে নিত, আমরা পায়া ধরে কোনোমতে আটকে রাখছি।’
উড়ে যাওয়া ঘরের জায়গায় ত্রিপল দিয়ে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছেন আল আমিন। তিনি বলেন, ‘ঘর বানানোর মতো টাকা নাই। এইবার ধানও পাইনি। কেউ সাহায্যও দেয়নি। তাই ত্রিপল দিয়েই কোনো রকমে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করেছি।’
সুনামগঞ্জে কালবৈশাখী এ ঝড়ে তাহিরপুর, শান্তিগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলার বেশকিছু ঘরবাড়ি, মসজিদ ও স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উজ্জ্বলপুর গ্রাম। তবে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা বুধবার রাত পর্যন্ত নিরূপণ করতে পারেনি জেলা প্রশাসন।
ঝড়ে ভেঙে পড়া ঘরের ভেতরেই রান্না করছিলেন উজ্জ্বলপুর গ্রামের সায়েদা বেগম। বাতাসের কারনে চুলায় আগুন ধরাতেই বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। সায়েদা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘর তো আর আইজ বানানি সম্ভব নায়, কিন্তু খাওন তো বন রাখা যাইতো নায়। খানির লাগি বাইচ্চারা কান্দের। তাই কষ্ট অইলেও রান্দতে (রান্না করতে) অর।’
বাড়িঘর নাই, এখন আমরা রোহিঙ্গা- এমন মন্তব্য করে কামরুজ্জামান বলেন, ‘এক দিন পেরিয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের কোনো সাহায্য দেয়নি। ঘরে খাবারই নেই, আমরা ঘর বানাব কী দিয়ে?’
ঝড়ে বই উড়িয়ে নিয়েছিল চাঁদনীর। স্থানীয় স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সে। উড়ে যাওয়া বই কুড়িয়ে এনে রোদে শুকাতে দিয়েছে চাঁদনী। বইয়ের অনেক পাতা ছিঁড়ে গেছে। সে বলে, ‘অনেক বইখাতা আর কোনো কাজেই লাগবে না। ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গেছে সব।’
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাশ্ববর্তী কান্ডবপুর গ্রামের অনেক বাড়ি ও পনঢুপ বাজারের অনেক দোকানপাট ও মসজিদ।
স্থানীয় মসজিদের মোয়াজ্জিন মাওলানা রশিদ আহমদ বলেন, ‘ঝড়ে মসজিদের ঘর উড়িয়ে নিয়েছে। খোলা আকাশের নিচেই নামাজ পড়তে হয়েছে। আমার নিজের থাকার ঘরও উড়িয়ে নিয়েছে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আলী আহমদ মুরাদ বলেন, ‘ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি দেখতে বুধবার উজ্জ্বলপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় সবকটি বাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। তাদের সহায়তা করা হবে।’
সুনামগঞ্জের দুর্যোগ ও ত্রাণ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঝড়ে বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করছি। এরপর সহায়তা করা হবে।’