১৮ মাস ধরে বেতনভাতা পান না ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা সদরে অবস্থিত কাজী সিরাজুল ইসলাম মহিলা কলেজের স্নাতক (সম্মান) শাখার সাত শিক্ষক। এ অবস্থায় করোনা মহামারির মধ্যেও মানবেতর জীবন যাপন করছে তাদের পরিবার।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অধ্যক্ষের খামখেয়ালিপনা ও উন্নয়নের নামে অতিরিক্ত অর্থ খরচের কারণে বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
সূত্র জানিয়েছে, বেতন চেয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে গত ২৫ এপ্রিল কলেজ ক্যাম্পাসেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক শিক্ষক। পরদিন শিক্ষক ফোরামের সভায় এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে কলেজটিতে সমাজকর্ম, বাংলা, ব্যবস্থাপনা ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক চালু হয়। চার বিষয়ে স্নাতক কোর্সে নন-এমপিও (যাদের সরকারি বেতন-ভাতা বরাদ্দ নেই) শিক্ষক রয়েছেন সাতজন।
নিয়োগের শর্তানুযায়ী, নন-এমপিও ওই শিক্ষকদের মাসিক বেতনের ১৮ হাজার টাকা সম্মান শাখার শিক্ষার্থীদের বেতন ও কলেজের অন্যান্য আয় থেকে পরিশোধ করা হবে। কিন্তু নানা অজুহাতে তাদের বেতন ১৮ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে।
১৯ এপ্রিল কলেজ পরিদর্শনে আসেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলাম। ওইদিন শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে স্নাতক শাখার সমাজকর্ম বিষয়ের প্রভাষক রণজিৎ কুমার মণ্ডল তাদের বেতন-ভাতা না পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওই শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়ার হুমকিসহ নানা ভয়ভীতি দেখান অধ্যক্ষ।
জানা গেছে, দুর্দশার কথা শুনে সাবেক সাংসদ কাজী সিরাজুল ইসলাম ব্যক্তিগত তহবিল থেকে স্নাতক শাখার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য অধ্যক্ষকে ৫ লাখ টাকার একটি চেক দেন। ওই টাকা থেকে ৭ শিক্ষকের প্রত্যেকের তিন মাসের বেতন-ভাতা বাবদ ৫৪ হাজার টাকা করে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে গত রোববার ভুক্তভোগী সাতজনের মধ্যে ছয় শিক্ষককে বেতনের টাকা পরিশোধ করলেও প্রভাষক রণজিৎ কুমার মণ্ডলের বেতন পরিশোধ করা হবে না বলে জানিয়ে দেন অধ্যক্ষ। এতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে নিজের বিভাগে গিয়ে বেলা ২টার দিকে হিট স্ট্রোক আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারান রণজিৎ মণ্ডল। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান সহকর্মীরা। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
প্রায় সাত ঘণ্টা পর রাত ৯টার দিকে রণজিৎ মণ্ডলের জ্ঞান ফেরে। তিনি এখনও ওই হাসপাতালেই ভর্তি আছেন।
এ ঘটনায় গত সোমবার কলেজের শিক্ষক মিলনায়তনে ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলামের সভাপতিত্বে শিক্ষক ফোরামের সভা হয়। সভায় ৩৫-৪০ জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। সভায় শিক্ষক রণজিৎ কুমার মণ্ডলের প্রতি অধ্যক্ষের এমন আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয় বলে একাধিক শিক্ষক নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজটির কয়েক শিক্ষক দাবি করেন, ২০২০ সালে বর্তমান অধ্যক্ষ যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত কলেজের তহবিল থেকেই নন-এমপিও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা হতো। কিন্তু বর্তমান অধ্যক্ষ যোগ দিয়ে কলেজ অংশের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি মাসে তিনি তহবিল থেকে ৩০ হাজার টাকা গ্রহণ করছেন। এ ছাড়া উন্নয়নের নামে ও বিভিন্ন খাতে বেপরোয়া ব্যয়ের কারণে কলেজ তহবিল কমে যাওয়ায় শিক্ষকদের বেতন পরিশোধে অনীহা দেখাতে শুরু করেন অধ্যক্ষ।
প্রভাষক রণজিৎ মণ্ডলের স্ত্রী আলফাডাঙ্গা উপজেলার শিরগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিরা সরকার বলেন, ‘আমার স্বামী কলেজের অনার্স শাখার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা না পাওয়ার বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিকে জানিয়েছেন, এটাই তার অপরাধ। এ জন্য কলেজের অধ্যক্ষ তার স্বামীকে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষা শুনিয়েছেন। তার বেতন বন্ধ করাসহ চাকরি থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফরিদ আহমেদ জানান, ‘শিক্ষক রণজিৎ মণ্ডলের সঙ্গে তার কোনো কথাই হয়নি। উল্টো তিনি অসুস্থ হওয়ার পর কলেজের পক্ষ থেকে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর ওই শিক্ষক আগে শিক্ষা ছুটিতে থাকায় ছুটির হিসাব না দেখে তাকে বেতন দেয়া সম্ভব নয় বলেও জানানো হয়েছিল।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি কলেজ থেকে যেসব সুবিধা নিই, তা পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তেই।
শিক্ষক ফোরামের সভায় নিন্দা জানানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই সভায় শিক্ষকেরা তার বিরুদ্ধে মনগড়া কথাবার্তা বলেছেন। এগুলোর সত্যতা নেই।’