বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা হ্যাচারিতে দেশে প্রথমবারের মতো শোল মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন।
চলতি এপ্রিল মাসে ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহে অবস্থিত স্বাদুপানি কেন্দ্রে এ সফলতা পাওয়া যায়।
গবেষক দলের প্রধান ছিলেন ড. মো. শাহা আলী। তার সঙ্গে ছিলেন আশিকুর রহমান, রবিউল আওয়াল, মালিহা খানম, ফারজানা জান্নাত আঁখি ও সাইফুল ইসলাম।
বিএফআরআইয়ের এক কর্মকর্তা জানান, দেশে মিঠাপানির দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় মাছ শোল। মাছটি খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ থাকায় বাজারে চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া চীন, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ মাছ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে একসময় খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলাধারা ও প্লাবনভূমিতে শোল মাছ প্রচুর পাওয়া যেত। বর্তমানে জলাশয় সংকোচন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পানি দূষণ এবং অতি আহরণের ফলে মাছটির বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় এর প্রাপ্যতা সাম্প্রতিক অনেক হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে এ মাছের বাজার মূল্য অনেক বেশি।
এ কর্মকর্তা আরও জানান, মাছটিকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে বিএফআরআই ময়মনসিংহে স্বাদুপানি কেন্দ্রে এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন নিয়ে গবেষণা শুরু করা হয়। গবেষণার মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো হ্যাচারিতে চলতি মাসে দেশীয় শোল মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যায়।
গবেষক রবিউল আওয়াল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গবেষণায় দেখা যায়, এ মাছের প্রজননকাল সাধারণত এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত হলেও এপ্রিল-আগস্ট এদের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী মাছ আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়।
‘এ মাছের ডিম্বাশয় এপ্রিল মাস থেকে পরিপক্ব হতে শুরু করে। এপ্রিলে স্ত্রী মাছের জিএসআই মান গড়ে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ফেকান্ডিটি (ডিম ধারণক্ষমতা) ১৩ হাজার থেকে ২১ হাজার। প্রতি গ্রাম স্ত্রী মাছে গড়ে ৮০-৯০টি ডিম পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘হ্যাচারিতে কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশে সুস্থ-সবল দেশি শোল মাছ নেত্রকোণা ও হাওরাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে গবেষণাকেন্দ্রের পুকুরে প্রতি শতাংশে ১০-১২টি হারে মজুত করা হয়। মজুত করা পুকুরে জলজ আগাছা (কচুরিপানা, কলমিলতা, ডালপালা) দেয়া হয়।
‘মজুত করা মাছকে ওজনের শতকরা ছয় থেকে তিন ভাগ হারে খাবার দেয়া হয়। প্রায় এক বছর পুকুরে লালন-পালনের পর কৃত্রিম প্রজননের জন্য এপ্রিলের শুরুতে এর জিএসআই মান দেখে পরিপক্ব স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নির্বাচন করে পুকুর থেকে সংগ্রহ করা হয়। কৃত্রিম প্রজননের ৬-৭ ঘণ্টা আগে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ পুকুর থেকে সংগ্রহ করে ছয় জোড়া মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয়। এরপর স্ত্রী ও পুরুষ মাছ ১:১.৫ অনুপাতে হ্যাচারিতে রাখা হয়।’
রবিউল আওয়াল আরও বলেন, ‘ইনজেকশন দেয়ার ৩০-৪০ ঘণ্টা পর স্ত্রী শোল মাছ ডিম দেয়। এ মাছের ডিম পানির ওপরের দিকে ভেসে থাকে। মাছটি স্বজাতিভোজী হওয়ায় ডিম দেয়ার পর ব্রুড মাছ দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হয় এবং অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। ডিম দেয়ার ৩০-৩২ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে।
‘ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার পর হাঁপাতে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা রাখতে হয়। রেণুর ডিম্বথলি ৬০-৭০ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশেষিত হওয়ার পর প্রতিদিন চার-পাঁচবার মুরগির সেদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে হাঁপায় সরবরাহ করা হয়। এ মাছের স্বগোত্রভোজী স্বভাব থাকায় ডিমের কুসুম সেদ্ধ চার থেকে ৫ ঘণ্টা পরপর দিতে হবে। হাঁপাতে রেণু পোনাকে এভাবে তিন-চার দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। গবেষণায় পোনা বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ হার ছিল ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ।’
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, ‘একটি শোল মাছের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ এক মিটার এবং ওজনে পাঁচ কেজি পর্যন্ত হয়। শোল মাছ সাধারণত কর্দমাক্ত ও জলাবদ্ধ স্থান এবং যেখানে জলজ আগাছা রয়েছে এমন স্থানে বেশি পাওয়া যায়। এ মাছের প্রধান আবাসস্থল খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড়। এ মাছ সাধারণত জলাশয়ের নিচের স্তরে বসবাস করে; কিন্তু ওপরের স্তরের খাবার গ্রহণ করে।
‘শোল মাছ মাংসাশী শ্রেণির। এরা জুপ্লাংটন, পোকামাকড়, ছোট মাছ, ব্যাঙ, মশার শূককীট এবং জলজ কীটপতঙ্গ খায়। বাজারে বড় এক কেজি শোল মাছের দাম ৭০০-৮০০ টাকা।’
তিনি বলেন, ‘শোল মাছের প্রজনন ও চাষ অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত জটিল। এরা অন্যান্য মাছের মতো খৈল ও কুঁড়াজাতীয় খাবার খেতে অভ্যস্ত নয়। ফলে পোনা তৈরির জন্য মা-বাবা অর্থাৎ ব্রড মাছ তৈরি করা খুব কষ্টকর বিষয় ছিল। প্রথমে এদের প্রোটিনসমৃদ্ধ দেশীয় একটি খাবারে অভ্যস্ত করা হয়েছে। এরপর ব্রড তৈরি করে হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে পোনা তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া এ মাছটি স্বজাতিভোজী হওয়ায় একটি আরেকটিকে ধরে ধরে খায়। ফলে পোনা বাঁচিয়ে রাখাও ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ।’
গবেষক দলের প্রধান মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শাহা আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে শোল মাছের নিবিড় চাষ করা হয়। আমাদের দেশে দেশীয় শোল মাছের পোনা না থাকায় এ মাছটিকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছিল না।
‘এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য ইনস্টিটিউটটি থেকে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর চলতি বছরে সফলতা আসে। পোনা উৎপাদিত হওয়ায় শোল মাছকে এখন চাষের আওতায় আনা হয়েছে।’
শোল মাছের পোনা। ছবি: নিউজবাংলা
ড. শাহা আলী বলেন, ‘প্রাইভেট খামারিদের উদ্যোগে চাষের জন্য ২০১১ সালে ভিয়েতনামি শোল মাছের পোনা দেশে আমদানি করা হয় এবং চাষাবাদ শুরু করা হয়। কিন্তু বিদেশি এ মাছ দেশে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।
‘আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে দেশীয় শোল মাছের পোনা উৎপাদন প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে হস্তান্তর করা হবে। চাষের মাধ্যমে এ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ মাছটি রপ্তানি করা যাবে।’
শোল মাছের পুষ্টিগুণাগুণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ মাছে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও মিনারেল রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মাছে প্রোটিন ১৬ দশমিক ২ গ্রাম, আয়রন শূন্য দশমিক ৫৪ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৯৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস শূন্য দশমিক ১৯ মিলিগ্রাম, জিংক ১ হাজার ৮০ মাইক্রোগ্রাম। আমরা মাছটির পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়ায় দেশে শোল মাছ চাষে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। মাছটি আকারে বড় হওয়ায় দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘দেশীয় শোল মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করা ছিল ইনস্টিটিউটের জন্য একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ গবেষণার পর চলতি এপ্রিল মাসে শোল মাছের প্রজনন বিষয়ে সফলতা আসে। চলতি বছরে দেশি শোল মাছের পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন হওয়ায় এ মাছ চাষের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।’
পরিসংখ্যানমতে, ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে দেশীয় ছোট মাছের পোনা তৈরি করা হচ্ছে। এতে দেশীয় মাছের পোনাপ্রাপ্তির সহজতর হওয়ায় গত ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের উৎপাদন চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ দশমিক ৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।