নেত্রকোণার খালিয়াজুরী উপজেলায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ কেটে দেয়ার মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হেকিমসহ অভিযুক্ত ১৭ জনের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এ কারণে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, লোকমানসহ অভিযুক্তরা গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের খোঁজ পেলেই আটক করা হবে।
নেত্রকোণার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী ও খালিয়াজুরী থানার ওসি মজিবুর রহমান আসামিদের আত্মগোপনে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) উপসহকারী প্রকৌশলী ওবায়দুল হক বাদী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হেকিম, রেজাউল কবিরসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় সরকারি সম্পদ ও ফসলের ক্ষতি সাধনের অভিযোগ আনা হয়।
জানা গেছে, মামলার প্রধান অভিযুক্ত লোকমান খালিয়াজুরীর মেন্দিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগে যোগদানের আগে তিনি প্রথমে যুবদল ও পরে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও পরাজিত হন। অপর অভিযুক্ত রেজাউল কবির মেন্দিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি লোকমানের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সহযোগী।
পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী ওবায়দুল হক স্থানীয় কৃষকদের বরাতে জানান, সোমবার রাতে লোকমান ও রেজাউল তাদের লোকজন নিয়ে জগন্নাথপুর এলাকার নন্দের পেটনা হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধটির ২০-২৫ ফুট জায়গা কেটে দেন। নন্দের পেটনা এলাকায় ‘পেটনা বিল’ নামে লোকমান হেকিমের একটি জলমহাল আছে। ওই জলমহালে হাওরের পানি ও মাছ ঢোকাতেই রাতের আঁধারে তারা নিজেদের লোকজন দিয়ে বাঁধটি কেটে দেন।
এতে আশপাশের হাওরের বোরো ক্ষেতে পানি ঢুকতে শুরু করে এবং খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলার কয়েকটি হাওরের উঠতি বোরো ফসল মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে।
এদিকে বাঁধ কেটে দেয়ার খবরে রাতেই এলাকার কৃষকরা ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে লোকমানকে ধাওয়া করেন। এ সময় লোকমান ঘটনাস্থলে তার মোটরসাইকেল ফেলে রেখে দৌড়ে আত্মরক্ষা করেন। পরে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা লোকমানের মোটরসাইকেলটি পানিতে ফেলে দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জগন্নাথপুর গ্রামের কয়েক কৃষক ও মৎস্যজীবী জানান, লোকমান হেকিম ‘পেটনা বিল’ নামে যে জলমহালটি ভোগদখল করছেন এটিও আসলে তার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা নয়। সরকারিভাবে এটি ‘ইসলামপুর মৎস্যজীবী সমিতি’ নামে একটি মৎস্যজীবী সংগঠনের নামে ইজারা দেয়া। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে লোকমান ও তার কয়েক সহযোগী এটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর প্রকৃত মৎস্যজীবীরা (যাদের নামে বন্দোবস্ত) ওই জলমহালে এখন শ্রমিক হিসেবে দিনমজুরি করছেন।
ওই কৃষক ও মৎস্যজীবীরা দাবি করেন, লোকমান সরকারি দলের এক জনপ্রতিনিধির পিএসের স্নেহধন্য। ওই পিএসই বিএনপি থেকে আসা লোকমানকে সরকারি দলের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। বড় পদ পাইয়ে দেন। এ কারণে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার আর অসৌজন্যমূলক আচরণের জন্য এলাকায় দিন দিন জনপ্রিয়তা হারান এই নেতা। এ কারণেই গত ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়েও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাঁধ কাটার পরও লোকমানসহ অন্যরা এলাকায়ই ছিলেন। কিন্তু তখন পুলিশ তাদের ধরেনি। প্রশাসনও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়নি। মামলার খবর পেয়েই তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন।’
খালিয়াজুরী থানার ওসি মুজিবুর রহমান বলেন, ‘মামলায় অভিযুক্ত কেউই এখন এলাকায় নেই। আমরা তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। পাশাপাশি মামলাটিরও তদন্ত শুরু করেছি।’
নেত্রকোণার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সীও সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আসামি দেখামাত্রই গ্রেপ্তার করা হবে।’
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেত্রকোণা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত জানান, পাউবো, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কৃষকদের চেষ্টায় বুধবার সকালের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত ফসলরক্ষা বাঁধটি সম্পূর্ণভাবে মেরামত করা সম্ভব হয়েছে। বাঁশ, মাটি, বালু, জিও ব্যাগ, চাটাই ও খড় দিয়ে বাঁধটি মেরামত করা হয়।
খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জসীম উদ্দিন বলেন, ‘বাঁধটি রক্ষার ফলে খালিয়াজুরী ও মদনের বিভিন্ন হাওরের প্রায় ২৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান রক্ষা পেয়েছে।’