রওজা মনির বয়স এখন ৭ বছর ১০ মাস। তার জন্মের দুই মাস আগে খুন হন গাড়িচালক বাবা জাহাঙ্গীর আলম। বাবার আদর, ভালোবাসা পায়নি রওজা। তবে বাবার ছবির সঙ্গে সে প্রায়ই কথা বলে, ধরে নানা বয়না। আর সেই দৃশ্য দেখে কাঁদেন রওজার মা নুপুর আক্তার।
আট বছর আগে এই দিন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকার, তার গাড়িচালক মো. ইব্রাহিম, যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, নজরুলের সহযোগী তাইজুল ইসলাম ও তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনকে অপহরণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর তিন দিন পর শীতলক্ষ্যায় একের পর এক ভেসে ওঠে তাদের মরদেহ।
সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলীতে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে থাকেন নুপুর আক্তার। কাজ করেন সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কার্যালয়ে। বুধবার দুপুরে তার কদমতলীর বাড়িতে যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিলের কথা তুলতেই ভিজে ওঠে নুপুরের চোখ। কিছুটা সময় নিয়ে কথা বলা শুরু করেন তিনি। বলেন, ‘সুখের সংসার ছিল তার। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সাত বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এই বছরগুলোয় জীবন সংগ্রাম কাকে বলে জেনেছি। তবুও হাল ছাড়িনি। যতদিন পর্যন্ত ওই খুনিদের ফাঁসি কার্যকর না হবে, ততদিন পর্যন্ত শান্তি পাব না।’
তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েটা দিন দিন বড় হচ্ছে। ও এখন বোঝে ওর বাবা নেই। তবুও যখন দেখে অন্যের বাবারা তার ছেলেমেয়েদের এটা-ওটা কিনে দিচ্ছে তখন ও বাবার ছবি ধরে কথা বলতে থাকে। আমি কাজ শেষে বাড়িতে এসে প্রায়ই এই দৃশ্য দেখি...।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই গলা ধরে আসে নুপুরের। গড়িয়ে পড়ার আগে চোখের জল মুছে নেন তিনি। একটা বড় শ্বাস নিয়ে আবারও বলতে শুরু করেন।
তিনি বলেন, ‘মেয়ে বড় হয়ে যখন জানতে চাইবে তার বাবা কীভাবে মারা গেছে। তখন আমি কী উত্তর দেব সে কথাই ভাবি। ও যখন জানতে চাইবে যারা তার বাবাকে মেরেছে, তাদের কী শাস্তি হয়েছে...। আমি আমার মেয়েকে বলতে চাই, যারা তোমার বাবাকে মেরেছে তারা ফাঁসিতে ঝুলে মরছে। উচ্চ আদালতের কাছে আমার দাবি, মামলার রায়টি দ্রুত কার্যকর করা হোক।’
শুধু নুপুরই নয়, তার মতো স্বজন হারানো অন্য পরিবারগুলো দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছে।
নিহত তাইজুলের বাবা আবুল খায়ের বলেন, ‘আট বছর ধরে সন্তানের হত্যার বিচার চেয়ে ঘুরছি। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই, হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় দিয়েছে সেই রায় বহাল রেখে দ্রুত কার্যকর করা হোক।’
সাত খুনের ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় দুটি মামলা করেন। এক বছর তদন্তের পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় গোয়েন্দা পুলিশ।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। ১২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জন সাক্ষ্য দেন আদালতে।
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফেটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম মাসুদ রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়।
পরে উচ্চ আদালতে ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে বাকি আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখা হয়। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়ের পর নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের মামলাটি এখন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
২০১৮ সালে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আসামিরা আপিল করেন। এরপর তিন বছর পেরোলেও এই আপিল শুনানি শুরু হয়নি।
সাত খুনের মামলার বাদী নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির সঙ্গেও কথা বলেছে নিউজবাংলা। তিনি বলেন, ‘আট বছরেও হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হয়নি। আমরা বার বার দাবি করে আসছি, দ্রুত রায় কার্যকর করা হোক। তারা আমাদের সাতটা পরিবার শেষ করে দিয়েছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে জীবনযুদ্ধ কতটা কঠিন আমরা জানি।’
বিউটি বলেন, ‘আমার স্বামী নজরুল সাহেব সারা জীবন আওয়ামী লীগ করে গেছেন। এখন ওই সরকারের আমলে যদি বিচার কার্যকর না হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় কষ্ট আমাদের আর নাই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, আপনি আমাদের প্রতি একটু দৃষ্টি দিন।’
আলোচিত এই মামলার রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী সাখাওয়া হোসেন খান। তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের বিচারকি আদালত থেকে যে রায়টি হয়েছিল তা নিয়ে জেলার মানুষ খুশি হয়েছিল। এরপর হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তাতেও আমার আস্থা ছিল। কিন্তু আসামিরা আপিল বিভাগে গিয়েছেন। মামলাটি এখন অ্যাপিলিয়েট ডিভিশনে আছে। রায় কার্যকরে যত দেরি হবে, তত বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হবেন।’