ঈদের আর বাকি কয়েক দিন। পুরোদমে কাজ করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শ্রমিকরা। ২৭ রমজানের মধ্যেই শেষ করতে হবে সব অর্ডারের কাজ।
গত দুই ঈদে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লোকসান গুনতে হয়েছে অনেক কারখানা মালিকদের। এবার আশা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার।
তবে লোডশেডিংয়ের কারণে কাজে ব্যাঘাত ঘটছে বলে অভিযোগ কারখানা মালিক-শ্রমিকদের।
স্টার ম্যাক্স পিও ফুটওয়্যারের পরিচালক সেলিম মিয়া জানান, প্রতি মাসে তাকে ৬ লাখ টাকা শ্রমিকদের বেতন হিসেবে দিতে হয়। মহামারির সময় কোনো মাসেই বেতন বন্ধ রাখেননি। তবে সে অনুযায়ী হয়নি কাজ। তাই লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে।
সেলিম বলেন, ‘এই ঈদে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। ইনশাআল্লাহ ক্ষতি পুষিয়ে আসবে। তবে যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুতের গোলযোগ। চার লেনের মহাসড়কের কাজের জন্য প্রায়ই সারা দিন বিদ্যুৎ থাকে না। টার্গেট পূরণ করাই কঠিন হয়ে গেছে।
‘সেই সঙ্গে ভ্যাট আর ট্যাক্স কর্মকর্তাদের চাপে আরও দিশেহারা হয়ে পড়েছি। নানান বিষয় বের করে তারা ভ্যাট নিচ্ছেন। ভ্যাট ছাড়া এমনিতেও কর্মকর্তাদের খুশি করতে হচ্ছে। যদি বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তাহলে আমাদের লভ্যাংশ বাড়বে।’
এ প্লাস পিও ফুটওয়্যারের পরিচালক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘ঈদ মৌসুমে আমাদের কারখানায় নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার জোড়া জুতার চাহিদা রয়েছে। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় শ্রমিকরা চাহিদা অনুযায়ী জুতা তৈরি করতে পারছে না।
‘লকডাউনের পর ভেবেছিলাম ব্যবসার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পাদুকা সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সদর উপজেলার ভাটপাড়া, নাটাই উত্তর ও নাটাই দক্ষিণ, পীরবাড়ি এলাকায় গড়ে উঠেছে অটোমেশিনে তৈরি জুতার কারখানা। মেশিন ও হাতে তৈরি মিলিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এখন আছে তিন শতাধিক জুতার কারখানা।
মেশিনে তৈরি জুতার কারখানাগুলোর প্রতিটিতে ৮০ থেকে ১০০ জন এবং হাতে তৈরি কারখানাগুলোতে প্রায় ৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এই কারখানাগুলোয় দেড়শ থেকে ৪০০ টাকা দামের জুতা-স্যান্ডেল তৈরি হয়।
চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহী থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে জুতা কেনেন। এরপর বিক্রি করেন খুচরা বাজারে।
এ প্লাস পিও ফুটওয়্যারের শ্রমিক জুয়েল মিয়া বলেন, ‘গত দুই বছর করোনার কারণে বাড়তি কাজ করতে না পারায় তেমন আয় হয়নি। খুবই কষ্টে ঈদ কেটেছে। এ বছর রোজায় বাড়তি কাজ করে বেতনের বাইরে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ইনকামের আশা করছি। এই টাকা দিয়ে সবার জন্য নতুন জামাকাপড় কিনব।’
সোহাগ সুজের মালিক সোহাগ মিয়া বলেন, ‘সাত থেকে আট বছর ধরে ব্যবসা করছি। ভালোই চলছিল। তবে করোনার প্রভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। পণ্য পাঠাতে পারছিলাম না, আবার অন্য জেলা থেকে অর্ডারও পাচ্ছিলাম না। কারিগরদের ঠিক সময়ে বেতন দিতে পারতাম না। ঋণ করে কারখানা চালু রাখছি।
‘তবে এই ঈদে ভালোই অর্ডার পেয়েছি। যদি অর্ডারগুলো ঠিকমতো করে পাঠাতে পারি তাহলে মালিক-শ্রমিক সবাই পরিবার নিয়ে ভালোভাবে ঈদ করতে পারব।’
ব্যবসায়ীরা জানান, জুতা তৈরির কাঁচামালের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তাই তেমন লাভ করতে পারছেন না।
তারা বলেন, জুতা তৈরির জন্য প্রয়োজন চায়না রেকসিন, স্টিকার, সুতা, পাথরের বোতাম, রিং, বেলফো ও কেমিক্যাল। প্রধান হচ্ছে রেকসিন ও কেমিক্যাল। এগুলোর দাম এখন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
চায়না রেকসিন আগে ছিল প্রতি গজ ৭০০ টাকা, এখন দাম ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। প্রতি গজ দেশি রেকসিনের দাম ২৫০ থেকে বেড়ে ৪০০-৪৫০ টাকা হয়েছে। আগে প্রতি লিটার কেমিক্যালের দাম ছিল ১৭৫ টাকা, এখন ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা।
জেলা পিও ফুটওয়্যার মালিক সমিতির সভাপতি মো. আমানউল্লাহ বলেন, ‘জুতা-স্যান্ডেলের ব্যবসা মূলত দুই ঈদ ঘিরে। বাংলাদেশে চায়নার কেমিক্যাল আমদানি কমে গেছে। তাই দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তা ছাড়া বিদ্যুতের সমস্যাও হচ্ছে খুবই বেশি। তবুও আশা করছি, সব সমস্যা কাটিয়ে লাভের মুখ দেখতে পারব।’
জেলা পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি কাজী শফিউদ্দিন জানান, পুরো বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তৈরি জুতার চাহিদা আছে। তবে বিদেশি জুতার কারণে এখন দেশি জুতা-স্যান্ডেলের কদর কমে গেছে। জুতা আমদানি কমিয়ে দিলে আমাদের জুতাগুলো প্রাধান্য পাবে। সরকার দেশীয় এই শিল্পের দিকে সুদৃষ্টি দিক এটাই তাদের দাবি।