ধারালো অস্ত্রের কোপে জখম হয়েছে শরীর। কবজি, স্তনসহ শরীরের নানা অংশে পড়েছে সেলাই। এক সপ্তাহ চিকিৎসা নিতে হয়েছে হাসপাতালে। নানা ওষুধে ক্ষত সেরেছে কিছুটা। তবে তীব্র যন্ত্রণা তাকে কাতর করে রেখেছে।হবিগঞ্জের মাধবপুরের বাঘাসুরা ইউনিয়নের বাড়িতে মঙ্গলবার সকালে গিয়ে দেখা যায় খাটে শুয়ে আছেন হামলার শিকার তরুণী। তাকে পানি খাওয়াচ্ছেন মা।
তিনি জানান, ‘মেয়েটা একা একা চলাফেরা করতে পারছে না। নড়াচড়া করতে গেলেই সেলাইয়ে টান পড়ছে। তখন সে গুঙিয়ে উঠছে। খেতে দিলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। শুধু পানি খেতে চাচ্ছে।’
নিজ বাড়িতে গেল মঙ্গলবার ভোররাতে হামলার শিকার হন ১৯ বছরের ওই তরুণী। সেহরির সময় ঘরের বাইরে বের হলে তাকে জাপটে ধরে কোপায় স্থানীয় সুমন মিয়া ও তার সঙ্গীরা। মেয়েটির চিৎকারে পরিবার ও আশপাশের লোকজন ছুটে এসে প্রথমে তাকে হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে ও পরে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে সোমবার বাড়িতে নেয়া হয়েছে মেয়েটিকে।
তরুণীর বাবা হবিগঞ্জ গ্যাসফিল্ড এলাকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মা নোয়াপাড়ার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক।
তিন ভাইবোনের মধ্যে মেয়েটি সবার বড়। লেখাপড়া করেছেন ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। এর পর থেকে ভাইবোনদের দেখাশোনা আর পরিবারের কাজে ব্যস্ত সময় কাটত তার।
আক্রমণের শিকার তরুণী বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সে (সুমন) আমাকে বিরক্ত করত। প্রথমে সে নাম-পরিচয় না দিয়া আমার দরজার সামনে চিঠি রাখত। পরে সে তার ফোন নাম্বার দিয়ে চিঠি রাখত।
আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করি না। কয়েক দিন পর আমাকে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমি তাকে না করে দেই। তখন সে আমাকে বলে আমার জীবন নষ্ট করে দেবে। কিন্তু লজ্জায় আমি কাউকে কিছু বলি না।’
বাড়ির এই টিউবওয়েলের পাড়ে হামলার শিকার হন তরুণী। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘১৯ তারিখ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঘরের পাশেই টিউবওয়েলে হাত-মুখ ধুতে যাই। মুখ ধুয়ে আসার সময় টিউবওয়েলের কাছেই আমার ওপর হামলা চালায় সুমন। এ সময় তার সঙ্গে নাইম ছিল। আমার পিঠে ও বুকে কোপ দেয়ার পর আমি চিৎকার দিয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকতে চাই।
‘কিন্তু দেখি ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সম্ভবত হামলার আগে তারা সেটি বন্ধ করে দেয়। দরজা খোলার চেষ্টা করার সময় সুমন আমাকে আরও কয়েকটি কোপ দেয়। পরে বাবা ঘর থেকে বের এলে সুমন ও নাইম দৌড়ে পালিয়ে যায়।’
হামলার ঘটনায় সোমবার সন্ধ্যায় ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেছেন তরুণীর বাবা। মামলার পর বিষয়টি জানাজানি হয়েছে।
তরুণীর মা বলেন, ‘ঘটনার দিন আমার নাইট ডিউটি ছিল। সকালে আমি বাড়িতে এসে দেখি আমার মেয়ে ঘরে নেই। পাশের ঘরের লোকজন আমাকে ঘটনা জানায়। পরে আমি সিলেট ওসমানী হাসপাতালে যাই।’
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকরা বলেছিলেন আরও কয়েক দিন হাসপাতালে থাকার জন্য। কিন্তু টাকাপয়সার সংকটে আমরা তাকে নিয়ে এসেছি। হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করালেও বিভিন্নভাবে অনেক খরচ করতে হয়।
‘প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজনরা কিছু সাহায্য সহযোগিতা করছেন। এই টাকা দিয়েই ওষুধ কিনে খাওয়াচ্ছি। ডাক্তার বলেছিলেন ঢাকা নিয়ে ভালো চিকিৎসা করাতে। কিন্তু এত টাকা পাব কোথায়।’
মেয়েটির প্রতিবেশী বান্ধবী ইমা বলেন, ‘আমরা মেয়েদেরকে কারণে-অকারণে মারবে। আমরা আর কত নিরাপত্তাহীনতায় থাকব। আমরা এ ঘটনার শাস্তি চাই।’
ওই তরুণীর বাড়ি থেকে আনুমানিক ৫০ মিটার দূরে মূল অভিযুক্ত সুমনের বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সুমনদের মাটির ছোট ঘরটি তালাবদ্ধ।
সুমনের মামি প্রতিবেশী তাসলিমা বেগম জানান, সুমনরা দুই বোন এক ভাই। তার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে সুমন। পরে সে ওলিপুরে চারু সিরামিকসে চাকরি নেয়। দুই বছর আগে অসুস্থতার কারণে সে চাকরি ছেড়ে দেয়। পরে বাড়ির সামনে ছোট একটি পাকা ঘর করে কম্পিউটার ও ভ্যারাইটিজের দোকান খোলে। দোকানের নাম দেয় ‘মা কম্পিউটার ও ভ্যারাইটিজ’ স্টোর।
সুমন ও তার পরিবারের লোকজন কোথায় গেছে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মামলার কারণে ভয়ে তারা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তবে ঘটনার সঙ্গে সুমন জড়িত না বলে দাবি করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ঘটনার খবর পেয়ে আমরা ওই মেয়ের বাড়িতে ছুটে যাই। তখন আমরাও টাকাপয়সা দিয়া তাকে সিলেট পাঠাই। সিলেট থেকে এসে বলে সুমন নাকি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’
সুমনদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে আরেক অভিযুক্ত নাইম মিয়ার বাড়ি। সেখানে গিয়ে তার বাবা-মাকে পাওয়া গেলেও নাইমকে পাওয়া যায়নি।
নাইমের বাবা ফেরদৌস মিয়া বলেন, ‘মেয়েটিকে কুপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে। আমি এর বিচার চাই। যদি আমার ছেলে জড়িত থাকে তাহলে আমার ছেলেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
মাধবপুর থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘সুমন ও নাইমের নামে থানায় আগের কোনো অভিযোগ নেই। মামলায় আসামি করা হয়েছে ৬ জনকে। তবে আমাদের প্রাথমিক তদন্ত বলছে, ঘটনার সঙ্গে সুমন ও নাইম জড়িত। আমরা তাদেরকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছি।’
হামলায় অভিযুক্ত সুমন (বামে) ও নাইম
মেয়েটির চিকিৎসার দায়িত্ব নিল প্রশাসন
হামলায় আহত তরুণীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
মেয়েটির বাড়িতে মঙ্গলবার বিকেলে যান মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈন। এ সময় তিনি বলেন, ‘তরুণীর চিকিৎসায় সব ব্যয় বহনসহ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক স্যার জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন থেকেও সহযোগিতা করা হবে।
‘আপাতত স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা যে পরামর্শ দেবেন সেই মোতাবেক তার চিকিৎসা হবে। এর জন্য যা যা করা দরকার, সব করা হবে।’