রাজধানীর কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠের জায়গায় থানা স্থাপনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়েছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। বর্তমানে তাপস ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র।
ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ) মো. ফারুক হোসেন নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ‘তাপস সাহেব সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় চিঠি দিয়েছিলেন।’
অবশ্য আগে ডিএমপি জানায় স্থানীয় এক সংসদ সদস্য মাঠে থানা স্থাপনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। কোন সংসদ সদস্য চিঠি দিয়েছিলেন তা জানায় না পুলিশ।
এমন অবস্থায় নিউজবাংলা ঢাকা-১০ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, এমন কোনো চিঠি তিনি পাঠাননি।
ঢাকা-১০ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি ২০২০ সালে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য হন।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক এই নেতার আগে সেখানে সংসদ সদস্য ছিলেন ফজলে নূর তাপস। তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে লড়ার সময় সংসদীয় আসনটি ছেড়ে দেন। পরে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তার আগে মাঠে থানার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন তিনি।
চিঠি দেয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, ‘তেঁতুলতলা মাঠের দায়দায়িত্ব যতক্ষণ পর্যন্ত সিটি করপোরেশনকে দেয়া না হচ্ছে, তার আগে এ বিষয়ে করপোরেশনের কোনো বক্তব্য নেই।’
অবশ্য তেঁতুলতলা মাঠ উন্মুক্ত রাখার পক্ষে বর্তমান সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘থানা ভবনের জন্য জায়গা চেয়ে আমি কোনো চিঠি দিইনি।’
অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে যে মাঠটি স্থানীয়রা ব্যবহার করে আসছেন খেলাধুলার জন্য, সেটি যেন উন্মুক্ত থাকে সে জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে বলে দাবি করেন শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। ছবি: ফেসবুকবর্তমানে তিনি ওমরা পালনের জন্য সৌদি আরবে আছেন। ফোনে যোগাযোগ করা হলে সংসদ সদস্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে এমনিতেই খোলা জায়গা কম। তার মধ্যে জনগণ যে জায়গাটি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে, তাদের জন্য সেই জায়গাটি ছেড়ে দেয়া উচিত। আমি সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। থানার জন্য জায়গা প্রয়োজন কিন্তু সেটি এই মাঠে না করে একটু কষ্ট হলেও অন্য কোথাও করা যেতে পারে। আশা করি এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
ডিএমপির কর্মকর্তা ফারুক হোসেন জানান, জনস্বার্থে কলাবাগান থানার জন্য ধানমন্ডি মৌজার ০.২০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ এর বিধি-বিধান অনুসরণ করা হয়েছে। কলাবাগান থানার জন্য অধিগ্রহণকৃত ০.২০ একর জমি জরিপ অনুযায়ী সরকারি সম্পত্তি ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন।
যে প্রক্রিয়ায় তেঁতুলতলা মাঠের জমি অধিগ্রহণ
১৪টি পয়েন্টে কলাবাগান থানার জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানিয়েছে ডিএমপি। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়-
১। কলাবাগান থানার জন্য ০.২০ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া যায়।
২। সরকারি প্রয়োজনে ও জনস্বার্থে রাজউকের কোনো আপত্তি নেই মর্মে ছাড়পত্র পায়।
৩। জায়গাটির প্রস্তাবিত ভূমি ব্যবহার Urban Residential Zone হিসেবে চিহ্নিত আছে মর্মে নগর উন্নয়নের ছাড়পত্র পাওয়া যায়।
৪। সরকারের প্রচলিত আইন ও নীতি অনুসরণে অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তি পত্র পাওয়া যায়।
৫। স্থানীয় সংসদ সদস্য, ঢাকা, উক্ত জমিতে এলাকাবাসীর নিরাপত্তার সুবিধার্থে স্থায়ীভাবে কলাবাগান থানা স্থাপনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর ডিও লেটার দেন।
৬। ঢাকা জেলা প্রশাসক সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে উক্ত জমি অধিগ্রহণের জন্য সুপারিশসহ ভূমি মন্ত্রণালয়ের মতামত পাঠান।
৭। সরকারের কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটিতে কলাবাগান থানার জন্য ০.২০ একর জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৮। জেলা প্রশাসক জমির ক্ষতিপূরণ মূল্য বাবদ পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি, ঢাকা বরাবর ২৭,৫৪,৪১,৭১০/৯২ টাকার প্রাক্কলন প্রেরণ করেন।
৯। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে ২৭,৫৪,৪১,৭১০/৯২ টাকার ব্যয় মঞ্জুরি পাওয়া যায়।
১০। জেলা প্রশাসক বরাবর প্রাক্কলিত টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়।
১১। গত ৩১ জানুয়ারি ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কর্তৃক সরেজমিনে ডিএমপিকে সেই জমির দখলভার হস্তান্তর করে।
১২। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভূমি অধিগ্রহণ শাখা-০৪, অধিগ্রহণ মামলা নং-০৪.২০.০৮/২০১৯-২০২০ কলাবাগান থানার ০.২০ একর জমি অধিগৃহীত ও দখল হস্তান্তর বিষয়ে বাংলাদেশ গেজেটের ৬ষ্ঠ খণ্ডে বৃহস্পতিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে প্রকাশ হয়।
১৩। গত ২৭ মার্চ জমির নামজারি ও জমাভাগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
১৪। প্রস্তাবিত থানার জায়গা তেঁতুলতলা মাঠ থেকে কিছু দূরে কলাবাগান মাঠ রয়েছে। সেখানে বাচ্চাদের খেলাধুলাসহ সামাজিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ রয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জনস্বার্থে সরকার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর কলাবাগান থানা নির্মাণের জন্য দেশের প্রচলিত সকল আইন কানুন মেনে বরাদ্দ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডিএমপি কোনো ব্যক্তির বা সংস্থার জমিতে বেআইনিভাবে থানা ভবন নির্মাণ করছে না। বিকল্প খেলার মাঠ ব্যবস্থার বিষয়টি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এখতিয়ারভুক্ত নয়।
তেঁতুলতলা মাঠটিতে খেলাধুলা, জানাজা, ঈদ জামাত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে আসলেও গত ৩১ জানুয়ারি থেকে তা বন্ধ। মাঠের জায়গায় কলাবাগান থানার স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য রোববার থেকে মাঠের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
মাঠ রক্ষার আন্দোলনে থাকা সৈয়দা রত্না ও তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহকে রোববার সকালে আটক করে পুলিশ। ওই মাঠ থেকে তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সরকারি কাজে বাধা দেয়ায় তাদের দুজনকে আটক করে প্রায় ১৩ ঘণ্টা আটকে রাখার পর রাতে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
কলাবাগানের বাসিন্দারা জানান, তেঁতুলতলা মাঠের এক বিঘা জমি একজন বিহারির মালিকানায় ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। সেই জায়গাটিতে স্থানীয় শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করত।
সরকারি খাস জমি হিসেবে নথিভুক্ত এই ফাঁকা জায়গাটিতে থানা করতে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। আর এর পর থেকেই সেই জায়গাটি খেলাধুলার জন্য ফাঁকা রাখার দাবি উঠেছে।