মাথায় টুপি, লম্বা দাড়ি আর সুন্নতি পাঞ্জাবি- এই লেবাসের নিচেই লুকিয়ে ছিলেন দুর্ধর্ষ অপরাধী মুফতি মামুন ওরফে ল্যাংড়া মামুন। এই বেশ একদিকে যেমন তাকে নিরাপদে অপরাধ সংগঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস অর্জন করে তাদের অর্থ আত্মসাতেও কাজে লেগেছে। লেবাসধারী মামুন সখ্য গড়ে তুলেছিলেন মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত।
মাথায় টুপি আর দাড়ি থাকলেও মাদক ব্যবসায় নিজস্ব সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন মামুন। ছিলেন মাদকসেবীও। তবে অপরাধ জগতে তার হাতেখড়ি হয়েছিল বড় ভাই মিজানের হাত ধরে। সাত বছর আগের চাঞ্চল্যকর আরেকটি অপহরণের ঘটনায় মিজানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। কিন্তু জামিনে বের হয়ে এখন আত্মগোপনে আছেন তিনি।
মামুনের আত্মীয়স্বজন, পুলিশ, এলাকাবাসীসহ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২০ কোটি টাকা মুক্তিপণের দাবিতে পটুয়াখালীর ব্যবসায়ী শিবু দাসকে অপরহরণের ঘটনায় ঢাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ল্যাংড়া মামুন ও তার ভাই মিজানের চাঞ্চল্যকর সব কাহিনি।
জানা গেছে, কৃত্রিম ডান পায়ের ভেতরে করে অনায়াসে লাখ লাখ টাকার ইয়াবা পাচার করা ছিল মামুনের অন্যতম অপরাধগুলোর একটি। এ ছাড়া পটুয়াখালী শহরের সদর রোডে থাকা মাতৃছায়া দোকানে বসেও অনেক পরিচিতজনকে ইয়াবা সেবনে আকৃষ্ট করতেন তিনি। আর শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে গাজীপুরা বাজারসংলগ্ন রাস্তার উত্তর পাশের চিহ্নিত এক বাড়িতে ছিল মামুনের নারী ও মাদকের আসর। দামি গাড়িতে চড়ে ওই বাসায় তাকে প্রায়ই যাতায়াত করতে দেখেছে আশপাশের মানুষ।
বরগুনার এক জনপ্রতিনিধির সঙ্গেও মামুনের ঘনিষ্ঠতার ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ওই জনপ্রতিনিধির মোটরসাইকেলের শোরুমটি মামুন আর তার ভাই মিজানই করে দিয়েছেন। ওই জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা ব্যবহার করে মামুন আসলে নিজের আখের গুছিয়েছেন।
অভিযোগ আছে, হুজুরি লেবাসের কারণে পটুয়াখালী শহরের অনেকেই লাভের আশায় নিশ্চিন্তে মামুনকে টাকা ধার দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘মামুনের কাছে আমি ৩৫ লাখ টাকা পাব। ব্যবসায়ে তিন ভাগ লাভ দেবে- এই শর্তে প্রথমে তাকে ৩ লাখ টাকা দিয়েছি। দেখছি- হুজুর মানুষ। সারা দিন হুজুরগো সাথে থাকে।
‘প্রথম ছয় মাস লাভের তিন ভাগ মামুন নিজে বাসায় এসে দিয়ে যেত। ধীরে ধীরে টাকার পরিমাণ বাড়াতে বাড়াতে ছয় মাস আগে আমি তাকে ৩০ লাখ টাকা দিই। কিন্তু এখন তো আমার সব শেষ।’
যে বাসায় মামুন তার পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন সেই বাসার মালিক পটুয়াখালী লঞ্চঘাট এলাকার মদিনা জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আবু ইউসুফ। তিনি জানান, দুই বছর আগে মাসে ১০ হাজার টাকায় তার বাড়ির তৃতীয় তলার একটি বাসা ভাড়া দেন মামুনের কাছে। ওই বাসায় স্ত্রী, তিন সন্তান ছাড়াও বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে বাস করতেন মামুন। পুরো পরিবারটিকে পরহেজগার হিসেবেই জানতেন বাড়ির মালিক ইউসুফ।
ইউসুফের ছোট ভাই শহরের বড় জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আবু সাইদের বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে সেখানে মাতৃছায়া দোকানের মালামাল রাখতেন মামুন।
ইউসুফ জানান, মামুন সব সময় লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি ও পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে থাকতেন। প্রতি শুক্রবার মদিনা মসজিদে তার পেছনে জুমার নামাজ আদায় করতেন। তার স্ত্রী সব সময় বোরকা পরতেন। বয়স্ক এবং বৃদ্ধ হওয়ায় মামুনের বাবা-মা তৃতীয় তলা থেকে নিচতলায় সচরাচর নামেন না।
ইউসুফ আরও জানান, মামুনের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ছেলেটি বড়। সে শহরের কেজি স্কুল সড়কে দারুল কোরান মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওই প্রতিষ্ঠানেই পড়াশোনা করছে মামুনের বড় ভাই মিজানের দুই মেয়েও। মিজানের খোঁজ নেই অনেক দিন ধরেই।
মামুনের অপরাধের কথা জেনে আবু ইউসুফ বলেন, ‘এ রকম একটা মানুষ আমার বাসায় ছিল বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মানুষ কত রঙের হতে পারে তা মামুনকে দিয়েই জানা গেল। সে লেবাসধারী এক অপরাধী। আগে জানলে তাকে বাসা ভাড়া দিতাম না। বর্তমানে তার পরিবারকে বাসা ছাড়ার জন্য বলেছি।
‘তবে এই মুহূর্তে মানবিক কারণেই তাদের বাসা থেকে বের করে দিতে পারছি না। কারণ মামুনের একটি নবজাতক রয়েছে; যার বয়স মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিন। তার বাবা-মা বৃদ্ধ। একজন মুসলমান হিসেবে এই অবস্থায় তাদের আমার বাসা থেকে বের করে দেয়া সঠিক হবে না। যদি মামুন জেল থেকে বের হয় কিংবা মামুনের কোনো অভিভাবক পাওয়া যায়, তবে তাদের জিম্মায় দিয়ে বাসা খালি করা হবে।’
এদিকে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, মামুন গ্রেপ্তার হওয়ার পরদিনই তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে অটোরিকশায় চড়ে লঞ্চঘাটে যান। সেখান থেকে যাত্রীবাহী একটি ডাবল ডেকার লঞ্চে চড়ে ঢাকায় চলে গেছেন। বর্তমানে পটুয়াখালীর ওই বাসায় মামুনের বাবা আর মা ছাড়া একজন কাজের মহিলা অবস্থান করছেন।
শহরের আদালতপাড়ায় বসবাসরত ব্যবসায়ী বিএনপির সাবেক নেতা গাজী মিজানুর রহমান সাইদ বলেন, ‘তিন বছরের চুক্তিতে হোটেল হিল্টনের পূর্ব পাশে একটি দোকান মাতৃছায়া বুটিকসের জন্য মামুনের কাছে ভাড়া দিয়েছিলাম। মাসিক ভাড়া ১ লাখ ১০ হাজার টাকা করে তিন বছরের জন্য অগ্রিম নেয়া হয়েছিল। পরে চলতি বছর জানুয়ারি মাসে হিসাব নিয়ে ঝামেলা করায় বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিলে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস আগেই ফেব্রুয়ারিতে মামুন আমার দোকান থেকে নেমে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি, পায়জামা-পাঞ্জাবি দেখে সন্দেহ করার কোনো উপায় ছিল না। তার পায়ে সমস্যা ছিল। তবে তার একটি পা যে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন তা আমরা জানতাম না। তা ছাড়া তার হাঁটাচলায় বোঝার উপায় ছিল না যে, এটি তার কৃত্রিম পা। মূলত লেবাস দেখে আর কথাবার্তায় রাজি হওয়ায় আমি দোকান বরাদ্দ দিয়েছিলাম। তবে সন্দেহ হয়েছিল কয়েক মাস আগের একটি ঘটনা শুনে।
‘আমার বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পাশে লোটো কোম্পানির জুতার শোরুমের মালিক আবদুর রহমানকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধর করে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল মামুন। তখন বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয় এবং মামলাও হয়। একপর্যায়ে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করে। কিন্তু পরের দিনই দেখি সে জামিনে বের হয়ে এসেছে। বিষয়টি এতদিন গোপন ছিল। শিবু লাল দাস অপহরণে মামুনের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় এ ঘটনাটি নিয়েও এখন আলোচনা হচ্ছে।’
এদিকে শহরের সবুজবাগ এলাকার এসপি কমপ্লেক্সের মালিক ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী গোলাম সরোয়ার বাদল বলেন, “আমার ভবনের দোতলার একটি রুম ‘বাংলাদেশ রং’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিই। মাসিক ৪০ হাজার টাকা ভাড়া হিসাবে ঈদের পর তাদের দোকানে ওঠার কথা। সেই হিসাবেই তাদের সঙ্গে আমার ডিড হয়েছে। কিন্তু শিবু দাস অপহরণের ১৫-১৬ দিন আগে মামুন এসে আমাকে বলে, ভাইয়া ওই দোকানটা আমার লাগবে। আমি ভাড়া নেব।
‘এই বলে আমাকে অনেক অনুরোধ করে। তখন ওর সঙ্গে পটুয়াখালীরই কয়েকটা ছেলে ছিল। আমি বলছি, দোকান তো ভাড়া হয়ে গেছে।
‘এমন কথা বলতেই মামুন বলে, যাদের সঙ্গে ভাড়া হয়েছে তাদের ভাড়াটারা আমি বুজবোআনে।
‘এই কথা বলেই মামুন চলে যায়। সাত-আট দিন পর কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তার আগের দোকান বা অন্য কোথাও থেকে কাপড় রাখার কিছু র্যাক আমার দোকানে রেখে গেছে। কোনো ডিড ছাড়াই র্যাক পাঠানোর পর আমি ওকে কয়েকবার ফোনও দিয়েছি। কিন্তু সে ফোন রিসিভ করেনি।’
মামুনের ভাই মিজানের কাহিনি
২০১২ সালের কোনো একদিন শহরের চৌরাস্তা এলাকার মধ্যবিত্ত মালেক মিয়ার কন্যা সুমা বেগমের সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিকভাবেই বিয়ে হয় মামুনের ভাই মিজানুর রহমান ওরফে রং মিজানের। বিয়ের পর তাদের দুই কন্যার জন্ম হয়। আর দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের কয়েক দিনের মাথায় মুক্তিপণের টাকা আনতে গিয়ে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন মিজান।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২ মে রাজধানীর বনানী থেকে টিএনজেড গ্রুপের মালিক মো. শাহাদাত হোসেনের আট বছরের সন্তান আবিরকে অপহরণ করে ১০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন ল্যাংড়া মামুনের বড় ভাই মিজান ও তার সঙ্গীরা।
ঘটনার চার দিন পর ৬ মে তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে মুক্তিপণের ৭৩ লাখ টাকা অপহরণকারীদের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়। ওই দিনই ঢাকার র্যাডিসন হোটেলের সামনে নগদ আরও ২৭ লাখ টাকা নিয়ে আবিরকে ফিরিয়ে দেয় মিজানসহ অন্যরা। পরে ১৭ মে পটুয়াখালী শহরের সদর রোডের মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে মুক্তিপণের টাকা তুলতে গেলে ওঁৎ পেতে থাকা র্যাবের একটি বিশেষ দল মিজানকে আটক করে।
পরের দিন ১৮ মে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় অপহরণের ঘটনায় একটি মামলা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২০১৯ সালের ১৬ মে ল্যাংড়া মামুনের ভাই মিজানসহ দুজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি আট আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার ৭ নম্বর নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. খাদেম উল কায়েস। কিন্তু তার পরও ভুয়া জামিনানামা দেখিয়ে আদালত থেকে বের হয়ে আত্মগোপনে চলে যান মিজান।
এ ব্যপারে কথা হয় মিজানের শ্বশুর মালেক মিয়ার সঙ্গে। লজ্জা ক্ষোভ আর হতাশাগ্রস্ত মালেক মিয়া বলেন, ‘সাত বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নাই জামাইসহ তার পরিবারের কারও সঙ্গে। আমরা বিষয়টা ভুলে গেছি। ভুলে থাকতেই চাই। আমার আর মেয়ের কপাল খারাপ ছিল। তাই আজ এ অবস্থা। সাত বছর ধরে মেয়ে আর দুটি নাতি লালন-পালন করে যাচ্ছি।’
জানা যায়, অভাবের তাড়নায় গ্রাম ছেড়ে পটুয়াখালী শহরে এসে মামুন ও মিজান পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা করেছিলেন। একপর্যায়ে পটুয়াখালীতে অবস্থান করে বড় চৌরাস্তায় ডেন্টিং-পেইন্টিংয়ের দোকান দিয়ে চোরাই মোটরসাইকেলের ব্যবসা শুরু করেন মিজান।
এ ছাড়া ঢাকা-পটুয়াখালী লঞ্চরুটে কেবিন বয়ের সুবাদে মাদক বহন, যানবাহনের জাল রেজিস্ট্রেশন এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন জালিয়াতিতে মিজান পারদর্শী ছিলেন। মিজানের হাত ধরেই অপরাধ জগতে পা দেন মুফতি মামুন ওরফে ল্যাংড়া মামুন।
তিন সঙ্গীসহ মামুনকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ
শিবু অপহরণ মামলার সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা ইনস্পেক্টর মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় পটুয়াখালী, আমতলী ও ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পুলিশ মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে বিআরটিসির চালক জসিম মৃধা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ায় তাকে ছাড়া বাকি ছয়জনকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হয়েছে।
কিন্তু এখনও রিমান্ড শুনানি হয়নি। কারণ ঢাকার ডিবি পুলিশ মামলার প্রধান আসামি মামুনসহ তার তিন সঙ্গীকে চার হাজার পিস ইয়াবাসহ ঢাকায় গ্রেপ্তার করেছে। তাই ওই মামলায় আসামিরা এখনও ঢাকায় রিমান্ডে আছে।