কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে তিন দফা নেতৃত্ব বদল হলেও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হয়নি। কলেজের ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, এক রকম ‘হেলায়’ তাদের কমিটি করেননি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব বদলের পর প্রতিবার কেন্দ্রীয় নেতারা এ কলেজে নিজেদের বলয় তৈরির প্রয়াস হিসেবে এই দীর্ঘ সময় ছাত্রলীগের কমিটি করেননি বলে মনে করেন ছাত্রলীগ নেতারা। সম্প্রতি ওই কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বিষয়টি সামনে এসেছে।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা বলছেন, এই কলেজের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অতীতে যে প্রভাব বলয়গুলো কাজ করত, তা এখন নেই। সেদিক থেকে বলা যায়, ছাত্রলীগের কেন্দ্রের জন্য নতুন কমিটি করা সহজ হওয়ার কথা হলেও আদতে তা হয়নি। কমিটি হলে সংঘর্ষ হতে পারে এমন শঙ্কা থেকে ছাত্রলীগের কমিটি হয়নি বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটি হয়েছিল ২০১৬ সালে। তাও হয়েছিল আহ্বায়ক কমিটি। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর নুর আলম ভূইয়া রাজুকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি অনুমোদন দেন ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন।
সে সময় কথা ওঠে, কমিটিতে ছাত্রলীগের সে সময়ের ‘সিন্ডিকেটের’ প্রভাব ছিল। সে প্রভাবের উৎস ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এক সাবেক সভাপতি। এ নিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমানদের মধ্যে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ।
পরে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি কলেজ ছাত্রলীগের এক মারামারিকে কেন্দ্র করে ওই কমিটির আহ্বায়ক নূর আলম ভূইয়া রাজুসহ ১৭ নেতাকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্রলীগের এক সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ইন্ধনেই মূলত গোলযোগ সৃষ্টি হয়। সেই কমিটি ভেঙে দেয়া না হলেও ছাত্রলীগের ওই আহ্বায়ক কমিটির নেতারা আর কলেজের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেননি। অনেকে যুবলীগে যুক্ত হয়ে কিংবা বিয়ে করে ছাত্র রাজনীতিতে ইতি টেনেছেন। এর পর থেকে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ওই ইউনিটে প্রায় পাঁচ বছর আর কমিটি হয়নি।
ছাত্রলীগের তৎকালীন আহ্বায়ক নুর আলম ভূইয়া রাজু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আহ্বায়ক কমিটি ছিল তিন মাসের। সাধারণত সেই কমিটি এক বছর পর্যন্ত চলে থাকে। কিন্তু এখন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হওয়া উচিত।’
গত সোমবার রাতে ঢাকা কলেজের সঙ্গে নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, এ কলেজে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কারা?
নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা হাতে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
সংগঠনে নেতৃত্বের কাঠামো থাকলে এ ধরনের সংঘাত এড়ানো যেত বলে অনেকে মনে করছেন।
এ সংঘর্ষের ঘটনায় কলেজের রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. রাকিব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন, তাই যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে তাদের একটা ভূমিকা সব সময় থাকে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়েছে। এর কারণে সোমবার রাতে সংঘর্ষের ঘটনাটি দীর্ঘ হয়েছে। তবে পরদিনের ঘটনা তৈরি হয়েছে উত্তেজনায়। যেহেতু ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলেন, তাই শিক্ষার্থীদেরও একটা অবস্থান নিয়ে থাকতে হয়েছে।’
ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজের এক নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কমিটি থাকলে বিষয়টি আরও তাড়াতাড়ি মীমাংসার দিকে যেতে পারত। আমরা শুধু এই অভাবটাই বোধ করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ছাত্রলীগের কমিটি থাকলে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক থাকত। নেতৃত্বও কমান্ড থাকত। সেটা ছিল না। এ কারণে নেতৃত্বহীনতায় ভুগতে হয়েছে। এ কারণেই বিষয়টি দীর্ঘায়িত হয়েছে।’
ছাত্রলীগের কমিটি কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কমিটি হলে কলেজ শাখা ছাত্রলীগে সংঘর্ষ হতে পারে, এমন ভয় পায় কেন্দ্র। এ কারণে আমাদের কমিটি হচ্ছে না।’
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি অনেক আগে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কমিটি এখনও না হওয়ায় নেতা-কর্মীরা হতাশ হবে, এটাই স্বাভাবিক। ছাত্রলীগে কমিটি দেওয়ার ব্যাপারে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের তো কোনো বাধা দেখছি না। আমার মনে হয়, কমিটি হওয়ার পর সংঘর্ষ হতে পারে- এই শঙ্কায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কমিটি দিচ্ছেন না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময়ে ছাত্রলীগে ‘সিন্ডিকেট’ হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন সাবেক নেতাও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগে ‘নিয়ামক’ ছিলেন। কিন্তু শোভন-রাব্বানী ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার সময় থেকেই তাদের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায় খোদ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে। এরপর ঢাকা কলেজের বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রের বাইরে আর কারও রাজনৈতিক তেমন একটা প্রভাব ছিল না।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘মূলত আমরা অবহেলার স্বীকার হয়েছি। কেন্দ্রীয় নেতারা মনেই করেননি, এখন কমিটি দেওয়া উচিত। কারণ সবাই এখানে নিজস্ব রাজনৈতিক শক্ত খুঁটি তৈরি করতে চেয়েছেন। এখনও যেমন বলতে পারি না বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি আমাদের কমিটি দিয়ে যেতে পারবে কি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় ঢাকা কলেজসহ ঢাকার কলেজগুলো মহানগর ছাত্রলীগের আওতায় ছিল। পরে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজসহ ঢাকার কয়েকটি কলেজকে সাংগঠনিক গুরুত্ব বিবেচনায় সাংগঠনিক জেলায় উন্নীত করা হয়। ঢাকা কলেজ সরাসরি চলে যায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রের আওতায়। এর আগে পর্যন্ত তৎকালীন মহানগর ছাত্রলীগের নেতারা ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকতেন। জেলা কমিটি হওয়ার পর যা তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। ফলে মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা যিনি ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, তিনিও গুরুত্ব হারান। সব ক্ষমতা চলে যায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রের হাতে। ঢাকা কলেজ হয়ে যায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রের জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে কলেজের সাবেক এক ছাত্র নেতা বলেন, ‘আমাদের যখন মহানগরের আওতায় কমিটি ছিল, তখন মহানগরের নেতারা কলেজের দায়িত্ব নিতেন। কিন্তু যখন থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের হাতে কলেজের দায়িত্ব গেছে, তখন থেকে কলেজ ছাত্রলীগকে কেন্দ্র এক ধরনের ব্যবহার করলেও কেউ দায়িত্ব নিতে চাননি। উদ্যোগের অভাব রয়েছে ছাত্রলীগের কমিটি করতে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, ‘বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মেয়াদ অনেক দিন হয়ে গেল, কিন্তু তারা তো কমিটি করলেন না। আসলে ঢাকা কলেজকে প্রোটোকল দেওয়ার জন্য তারা ব্যবহার করলেও অবহেলার চোখেই দেখেছেন। দায়িত্ব নিতে চাননি। এ জন্য কমিটি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘তবে এখনও যে কলেজে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা নেই, সেটা কিন্তু না। সেটা অবশ্যই আছে। কলেজে কমিটি না হওয়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রের দুর্বলতা।’
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, এইচ এস বদিউজ্জামান সোহাগ যখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সিদ্দিকী নাজমুল আলম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, তখন ২০১২ সালে ঢাকা কলেজের নেতৃত্বে আসেন এফ এইচ পল্লব ও সাকিব হাসান সুইম। পল্লবকে সভাপতি ও সুইমকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়। সেই কমিটিতে পল্লব সাবেক মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতার ও সুইম সিদ্দিকী নাজমুল আলমের ‘মাই ম্যান’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কলেজ ছাত্রলীগের এই কমিটি করা নিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যদিও তাতে তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্র কর্ণপাত করেননি। সেই দ্বন্দ্বের রেশ এখনও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের চলমান রয়ে গেছে বলে কলেজ ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা মনে করেন।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তিন দফা বদল
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ২০১৭ সাল থেকে তিন দফা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বদল। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেন্দ্রের সবাই চেয়েছে এখানে 'মাই ম্যান' বানাতে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তিন দফা পরিবর্তনে প্রত্যেক কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল নেতাই একটু যাচাই করে 'মাই ম্যান' বসাতে চেয়েছেন। ফলে প্রতিবার একটা দীর্ঘ সময় কমিটি দিতে বিলম্ব হয়েছে।’
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের এক নেতা নিউজবাংলার কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘যদি বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কমিটি না দিয়ে যান, তাহলে হয়তো কমিটি দিতে অনেক দেরি হতে পারে।’
ঢাকা কলেজের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রানা হামিদ। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা কলেজ আসলে একটি সেনসিটিভ এরিয়া। এ কারণে দেখে-শুনে কমিটি করতে আমাদের একটু দেরি হচ্ছে। তবে হয়তো রমজানের পর কমিটি হয়ে যাবে।’
কী সাংগঠনিক সমস্যা দেখছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওখানে অনেক যোগ্য নেতা আছেন। তবে এই যোগ্যদের মধ্যে বাছতে একটি দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু কমিটি হয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা। কিন্তু তারা ফোন ধরেননি।