লঞ্চে ঈদের আগে অগ্রিম টিকিট বিক্রিতে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করে লঞ্চমালিকদের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। গত ২০ এপ্রিল থেকে ঈদের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করলেও সে নির্দেশনার কিছুই পালন করছেন না লঞ্চমালিকরা।
সেই সঙ্গে কাউন্টারের টিকিট কালোবাজারিতে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন অনেক যাত্রী। তারা বলছেন, কাউন্টারে না মিললেও দালালরা বেশি দামে টিকিট বিক্রির অফার দিচ্ছেন। এ ছাড়া রয়েছে টিকিট বিক্রিতে চরম অব্যবস্থাপনা।
রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে অগ্রিম টিকিট কিনতে আসা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
আগামী ২৭ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত লঞ্চের ঈদের স্পেশাল সার্ভিস চলবে। দেশের ৪১টি নৌ রুটে শতাধিক লঞ্চ ঈদে যাত্রী আনা-নেয়া করবে।
সরেজমিনে সদরঘাট ঘুরে দেখা যায়, অগ্রিম টিকিট বিক্রির প্রথম দিন থেকেই যাত্রীদের খুব একটা চাপ নেই। তবে টিকিট বিক্রিতে অব্যবস্থাপনা ভোগান্তি বাড়াচ্ছে যাত্রীদের। নেই অনলাইনে টিকিট কাটার কোনো ব্যবস্থা।
যাত্রীদের অভিযোগ, তারা যেসব টিকিট কিনতে চান, তার বেশির ভাগই কাউন্টারে নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে কালোবাজারিতে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে বেশি দামে।
একাধিক যাত্রী নিউজবাংলাকে জানান, ঈদের আগে সব সময়ই বরিশাল থেকে ঢাকার টিকিট বিক্রি করা হয়। এতে কম টিকিট বিক্রি হয় এবং বাকি টিকিটগুলো মজুত করে রাখা হয়। ঈদের কয়েক দিন আগে এসব টিকিট কালোবাজারিতে বেশি দামে বিক্রি হয়। যাত্রীর চাপ যখনই একটু বেশি থাকে, ঠিক তখনই বরিশাল থেকে টিকিট বিক্রির কথা বলা হয়। অথচ লঞ্চের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছেই এসব টিকিট থাকে। পরে তারা বেশি দামে টিকিট বিক্রি করেন।
যাত্রাবাড়ী থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে টিকিট কাটতে যান আরিয়ান সুমন। অগ্রিম টিকিট কাটতে গিয়ে তিনি চাহিদার টিকিট পাননি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঈদের ভিড় এড়াতে টিকিট কাটতে আগেই এসেছি। কিন্তু কোনো লঞ্চেই টিকিট দিচ্ছে না। আবার স্পেশাল সার্ভিসের লঞ্চের টিকিট কবে দেয়া হবে তাও বলছে না।’
মিরপুর থেকে টিকিট কাটতে যাওয়া ওমর ফারুক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি আগেই এসেছি টিকিট কাটতে, কিন্তু এখানে এসে দেখি আরেক বিপদ। কেউ বলছে টিকিট কাটা লাগবে না, যেদিন যাব সে দিনই টিকিট পাব; আবার কেউ বলছে এখান থেকে কাটা যাবে না, বরিশাল থেকে কাটতে হবে। রোজা রেখে লঞ্চ টার্মিনালে আসাটাই বৃথা।’
বাড্ডা থেকে টিকিট কাটতে যান আসনা বেগম। তিনি বলেন, ‘২৮ তারিখের অগ্রিম টিকিট করতে এসেছিলাম। এসে দেখি টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। কবে থেকে শুরু হবে তাও কেউ বলছে না। রীতিমতো একটা ভোগান্তিতে পড়েছি।’
অবশ্য বেশ কয়েকজন জানান, তারা টিকিট পেয়েছেন কাউন্টারেই। তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পরিচয়পত্রের কোনো কথাই জিজ্ঞেস করেনি লঞ্চের কেউ। সরাসরিই তারা টিকিট পেয়ে গেছেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সদরঘাট থেকে পটুয়াখালী চলাচল করা কুয়াকাটা-১ লঞ্চটিতেই ঈদের আগের কয়েক দিনের কোনো টিকিট নেই। এ কোম্পানির আরেকটি লঞ্চ কুয়াকাটা-২ সদরঘাট থেকে বরিশাল পর্যন্ত চলে। কুয়াকাটা-২ লঞ্চের করণিক জানান, ঈদের টিকিট আগেই বিক্রি শুরু করেছেন। ২৮ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত কোনো টিকিট নেই তাদের।
একই অবস্থা অন্য দূরপাল্লার লঞ্চগুলোতেও।
অনেক লঞ্চে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা। ঢাকা থেকে বরিশালগামী এমভি সুরভী তিনটি লঞ্চেই সিঙ্গেল কেবিনে ১০০ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেড় হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। ডাবল কেবিনে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ২৬০০ টাকা, ডেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৪০০ টাকা করা হয়েছে। ভিআইপি হাজার টাকা বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা করা হয়েছে।
অবশ্য বাড়তি ভাড়া নেয়ার বিষয়টি নিয়ে লঞ্চটির মালিক, স্টাফ বা কোনো কর্মকর্তাই মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ঢাকা-বরিশাল-কীর্তনখোলাগামী পারাবত-১২ লঞ্চের ভাড়া অবশ্য আগেরটাই নেয়া হচ্ছে। লঞ্চটির পরিচালক শাহিন হোসেন বলেন, ‘আমাদের টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির কোনো নির্দেশনা এখনও দেয়া হয়নি। তাই আমরা নির্ধারিত ভাড়াই নিচ্ছি, পূর্বের ভাড়া বহাল রেখেছি।’
সুরভী-৭ লঞ্চের টিকিট বিক্রেতা মাইদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা টিকিট বিক্রি করছি। ভাড়া বেশি নেয়া হচ্ছে না। আমাদের যে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তাই নিচ্ছি। ঈদে স্পেশাল সার্ভিসের টিকিট বিক্রির বিষয়ে আমাদের জানানো হলে আমরা টিকিট বিক্রি করব।’
নির্দেশনা থাকলেও এনআইডির প্রসঙ্গই আসছে না টিকিট ক্রেতা-বিক্রেতা কিংবা লঞ্চ কর্তৃপক্ষের। নিউজবাংলার প্রতিবেদকের সামনেই বেশ কয়েকজনকে এনআইডি ছাড়া টিকিট কাটতে দেখা গেছে।
সুন্দরবন-১২ লঞ্চে শনিবার রাতের টিকিট করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিপা রানী সাহা। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লঞ্চে কেবিন পেলে এনআইডির প্রয়োজন হয়। ডেক বা সোফায় গেলে লাগে না।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সদরঘাটের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক শেখ মো. সেলিম রেজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিয়মিত শিডিউলের লঞ্চগুলো অগ্রিম টিকিট বিক্রি করছে। যাত্রীর চাহিদার ওপর নির্ভর করে তারা স্পেশাল সার্ভিস দেবে। সেগুলোর টিকিট তো আর এখন হবে না। যাত্রীর চাপ যখন হবে, তখন তারা স্পেশালের চিন্তা করবে। আর স্পেশাল লঞ্চ যখন আসবে তখন ওই লঞ্চের কেবিনগুলো তারা সেল করবে। নিয়মিত চলাচল করা লঞ্চে সবাই অগ্রিম টিকিট দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ঈদে যাত্রী চাহিদার ওপর নির্ভর করে লঞ্চ অবশ্যই বাড়বে। স্পেশাল সার্ভিস থাকবে, একটা লঞ্চ হয়তো দুইটা সার্ভিস দিবে। আমাদের কর্তৃপক্ষ থেকে এভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে। এবার আশা করা যাচ্ছে, যাত্রী চাহিদার ওপর নির্ভর করে ১৭০টি পর্যন্ত লঞ্চ চলাচল করবে।’
টিকিট কালোবাজারির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘টিকিট কালোবাজারি হলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এনআইডি প্রদর্শন নিয়ে জানতে চাইলে নিউজবাংলাকে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘টিকিট বিক্রির সময় যাতে এনআইডি নম্বর নিশ্চিত করা হয়, তা নিয়েও মালিকদের সঙ্গে কথা বলা হবে।’
বাংলাদেশ নৌ পুলিশের সদরঘাট নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাইয়ুম আলী সরদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি ভালো। ঈদ উপলক্ষে আমাদের অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। পুলিশ সুপার নৌ পুলিশ, ঢাকা অঞ্চল কর্তৃক নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশ ফোর্স মোতায়েন থাকবে। কন্ট্রোল রুম থাকবে। কয়েকটি ধাপে নৌ পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে।’