ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরা উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। এই জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় অর্ধশতাধিক ঐতিহাসিক স্থাপনা। পরিবার-পরিজন নিয়ে পর্যটকদের পক্ষে এক দিনে একাধিক ঐতিহাসিক স্থান দর্শন করা সম্ভব নয়। তাই স্বল্প খরচে এক দিনে একাধিক ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো ভ্রমণের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই প্রথম ট্যুরিস্ট বাস সার্ভিস চালু হতে যাচ্ছে।
এমন ঘোষণায় আনন্দিত নওগাঁবাসী। এরইমধ্যে ট্যুরিস্ট বাসের টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে।
স্থানীয়দের প্রত্যাশা, এই ট্যুরিস্ট বাস সার্ভিসে বদলে যাবে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, ‘নওগাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে দেশসহ বিশ্বের পর্যটকদের কাছে নতুন করে তুলে ধরতেই এমন উদ্যোগ নেয়া। নওগাঁর ইতিহাসে এই প্রথম আসন্ন ঈদুল ফিতরের দ্বিতীয় দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ট্যুরিস্ট বাস উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।’
নওগাঁর মান্দা উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন নিদর্শন ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি জানান, উদ্বোধনের পর প্রতিদিন ট্যুরিস্ট বাস শহরের মুক্তির মোড় থেকে সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু করবে। মুক্তির মোড়ের পদ্মা বাস কাউন্টার থেকে এই প্যাকেজের টিকেট পাওয়া যাবে। প্রাথমিক পর্যায়ে জেলা প্রশাসনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি বাস প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে ৪৫০ টাকাা।
জেলা প্রশাসক জানান, এই প্যাকেজের মাধ্যমে একজন পর্যটক খুব সহজেই প্রথমে ভারত সীমান্তঘেঁষা উপজেলা ধামইরহাট উপজেলার জাতীয় উদ্যান শালবন বিহারের আলতাদীঘি, ঐতিহাসিক জগদ্দল বিহার, বদলগাছী উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও হলুদ বিহার ভ্রমণ করতে পারবেন।
এ ছাড়া প্যাকেজের মাধ্যমে পর্যটকরা সকাল ও বিকেলের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার পাবেন। বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে প্রতিবার ভ্রমণের দিন বিকেলে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-তাত্তিক শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন।
পরে হলুদ বিহার দর্শন শেষে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড়ে এসে শেষ হবে ওইদিনের ভ্রমণ।
ঐতিহাসিক জগদ্দল বিহার। ছবি: নিউজবাংলা
প্রাথমিক পর্যায়ে ৪টি ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের রুট হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে পর্যটকদের চাহিদার উপর ভিত্তি করে জেলার সকল ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের জন্যও প্যাকেজ তৈরি করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান।
পর্যটকরা এই ভ্রমণের ফলে জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত হাজার হাজার বছর আগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সম্পর্কে নতুন করে জানার সুযোগ পাবেন বলেও প্রত্যাশা তার।
তিনি বলেন, ‘এসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বেশি বেশি পর্যটকদের আগমনের কারণে ওই সব স্থানের আর্থসামাজিক অবস্থা আরও উন্নত হবে। চাঙা হয়ে উঠবে বাণিজ্যিক ব্যবস্থা। নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে গড়ে উঠবে নতুন নতুন স্থাপনা আর সৃষ্টি হবে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান। আমূল পরিবর্তন আসবে এই পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা আর্থসামাজিক ব্যবস্থায়।’
নওগাঁ শহরের জনকল্যাণ মহল্লার বাসিন্দা মৌসুমী সুলতানা শান্ত বলেন, ‘এমন উদ্যোগ নওগাঁবাসীর জন্য সত্যিই খুবই আনন্দের। এমন উদ্যোগ নওগাঁর ইতিহাসে প্রথম। আমি নিজেও দুটি টিকিট কিনেছি আলতাদিঘী শালবনে যাব আমি ও আমার ছেলে।’
শহরের মাস্টার পাড়া মহল্লার বাসিন্দা সাইফুল আলম বলেন, ‘আমি একজন শিক্ষার্থী, ঢাকাতে পড়াশোনা করি। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। ইচ্ছে থাকলেও অনেক মানুষের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে এতোগুলো নিদর্শন ভ্রমণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এখন একটি প্যাকেজের মাধ্যমে খুব সহজেই ঐতিহাসিক চারটি পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করতে পারবেন। আমি টিকিট কাটব পাঁচটি। বগুড়া ও রাজশাহী থেকে আমার আরও চার বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে যাব।’
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আলাতাদীঘি জাতীয় উদ্যান ও শালবনের বন বিট কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ‘এটি জেলা প্রশাসনের নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। নওগাঁর ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ করা উচিত। সকলের জানা উচিত এই জেলার চমৎকার কিছু স্থান রয়েছে। আর পর্যটকরা আলতাদীঘিতে এলে জাতীয় উদ্যানসহ ভারতের সীমান্তও দেখতে পারবেন।’
নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শরিফুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের নওগাঁ জেলা ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিজড়িত জেলা। এই জেলায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য স্থাপনা, যেগুলোতে মিশে আছে হাজার বছর আগের ইতিহাস। তাই একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষের জন্য নওগাঁর এই সব ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ করার কোনো বিকল্প নেই।’
জেলার ধামইরহাট উপজেলার ঐতিহাসিক আলতা দিঘি। ছবি: নিউজবাংলা
এ ছাড়া এই উদ্যোগের মাধ্যমে নওগাঁর পর্যটন এলাকাগুলো নতুন করে পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত হবে বলে মনে করেন তিনি।
নওগাঁ জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রেজাউল মোস্তফা কালিমী বাবু বলেন, ‘অনেক নিম্ন আয়ের মানুষদের ইচ্ছে থাকলেও নিজের এলাকার পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণ করতে পারেন না। আবার শিক্ষার্থীদের জন্যও এই উদ্যোগ মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। তারা ইচ্ছে করলেই একদিনে স্বল্প খরচে এই ঐতিহাসিক স্থানগুলো ভ্রমণ করতে পারবেন।’
এসব ছাড়াও জেলায় রয়েছে ঐতিহাসিক কুসম্বা মসজিদ, রবি ঠাকুরের কাচারি বাড়ি পতিসর, বলিহার, দুবলহাটি রাজবাড়িসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান।