‘আইন দরকার জনগণকে রক্ষা করার জন্য, বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দিতে নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করা হয়েছে শাসকদের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে নয়। আইনটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এর শিকার বেশি হচ্ছেন সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদরা।’
শনিবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সভায় ‘অন্তঃহীন দুঃস্বপ্ন: ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ শীর্ষক গবেষণার মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজ। তিনি আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজেরও প্রেসিডেন্ট।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে এই গবেষণা পরিচালিত করা হয়েছে৷
গবেষণার তথ্য-উপাত্তে বলা হয়, এ সময়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ২ হাজার ২৪৪ জন অভিযুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মামলা হয়েছে ৮৯০ জনের বিরুদ্ধে। আটক হয়েছেন ৮৪২ জন। সে হিসেবে
প্রতিমাসে গড়ে অভিযুক্ত ৮৬, মামলার শিকার ৩২ ও আটক ৩৪ জন।
২৬ মাসের ওপর করা এই গবেষণায় বলা হয়, এই আইন প্রয়োগের প্রথম ১৬ মাসের তুলনায় পরবর্তী ৯ মাসে অভিযোগ, আটক ও মামলার সংখ্যা বেড়েছে।
পেশাগত বিবেচনায় দেখা গেছে, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামলা ও আটকের সংখ্যা বেশি। সাংবাদিকরা ২৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে এর শিকার হয়েছেন৷ এর মধ্যে ২০৮ জন অভিযুক্ত হয়েছেন। মামলা হয়েছে ১০৮ জনের বিরুদ্ধে।
রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগের হার ৪১ শতাংশ। শিক্ষকদের মধ্যে অভিযুক্ত ৪১ ও আটক ২৭ জন।
এছাড়া এনজিও, ছাত্র, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও ধর্মীয় নেতারা এ আইনের আওতায় ভুক্তভোগী। এমনকি পুলিশও অভিযুক্ত হচ্ছে।
বয়স বিবেচনায় দেখা গেছে- অভিযোগ, আটক ও মামলার ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৫ বছরের ৩০৩ জন, ২৬ থেকে ৪০ বছরের সবচেয়ে বেশি ৩৮৮ জন কোনো না কোনোভাবে এই আইনের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া ১৮ বছরের নিচে রয়েছে ১৯ জন এবং ৪১ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে রয়েছেন ১০৭ জন।
অভিযোগকারী কারা
গবেষণায় বলা হয়েছে, অভিযোগকারীদের মধ্যে র্যাব ১৯ ও পুলিশের পক্ষ থেকে ৮৭টি অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারের সমর্থনে মামলা হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ১১১টি মামলা করেছে। আর সরকারি কর্মচারী মামলা করেছে ৪৩টি৷
ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা এই আইনের বেশি ব্যবহার করেছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়েছে,
রাজনৈতিক দল-সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ৮১ শতাংশ।
যে ধারায় বেশি মামলা
গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় সবচেয়ে বেশি ১২৪টি মামলা হয়েছে। এছাড়া ২৯ ধারায় মামলা হয়েছে ১১৮টি।
ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা এই দুটি ধারাকে অন্যভাবে ব্যবহার করেছেন বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৯৮টি। আর রাজনৈতিক নেতাদের অবমাননার মামলা হয়েছে ৭৫টি।
ফেসবুকের বিপদ
ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট বা সংশ্লিষ্ট অন্য কারণে অনেকে এই আইনের আওতায় এসেছে। মামলার সংখ্যা ৫৬৮টি। এর মধ্যে হয়রানির অভিযোগে ৫১টি, আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে ২৯টি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে ৮৫টি এবং মতামত প্রকাশের জন্য ৩৯৯টি মামলা হয়েছে।
আলোচনা সভায় আর্টিক্যাল-১৯ এর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘আইন দরকার জনগণকে রক্ষা করার জন্য; বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দেয়ার জন্য নয়। সরকার সোশ্যাল মিডিয়া কন্ট্রোল করা দরকার বলে মনে করে। কিন্তু এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। সাইবার ট্রাইব্যুনালে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের অধিকাংশের এ সম্পর্কে ধারণা নেই।’
ব্যারিস্টার তানিয়া আমির বলেন, ‘প্রথমে আইসিটি অ্যাক্ট পরে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হলো৷ আরো একটা আইন করা হবে। একের পর এক আইন করা হচ্ছে। কিন্তু আইনের মূল বিষয় পরিবর্তন হচ্ছে না। আইনে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে আঘাত করলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ভাবমূ্র্তি বলতে কী বোঝানো হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। এখানে রাষ্ট্রীয় ভাবমূ্র্তি ও সরকারকে এক করে ফেলা হয়েছে। এ দুটির মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা গভীরভাবে দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতির আঘাত এখানে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। কার ধর্ম, কার অনুভূতি, কেমন আঘাত- এ বিষয়গুলো দেখতে হবে। ইসলাম ধর্ম কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর মনোপলি না। এখানে দেখতে হবে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করলে কত জনগোষ্ঠীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। শুধু আইন করলেই হবে না, এসব বিষয় আগে পরিষ্কার হতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জনগণের স্বার্থে নয়, শাসকদের স্বার্থে করা হয়েছে। আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আইনে ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে অপব্যবহার করার জন্য। এই আইনের মতো আরও কিছু আইন স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করছে।