বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টিকায় ‘বাড়তি ব্যয়’ নিয়ে টিআইবির দাবি অনুমাননির্ভর

  •    
  • ২৩ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:২২

টিআইবির গবেষক মোহাম্মদ জুলকারনাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটি এস্টিমেশন (আনুমানিক হিসাব) করেছি। তাতে দেখা গিয়েছে, ১১ হাজার কোটি থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করছি, আসলে কী কী বাবদ কত টাকা খরচ হয়েছে সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তবে এটা যে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়।’

করোনাভাইরাসের টিকা কেনা এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকার যে হিসাব দিয়েছে, প্রকৃত খরচ তার চেয়ে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা কম বলে দাবি করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেই দাবি পুরোটা অনুমাননির্ভর বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির গবেষক।

বাংলাদেশ সরকার কার কাছ থেকে কত টাকা মূল্যে টিকা নিয়েছে, এসব বিষয়ে সংস্থাটির তথ্যের উৎস ইউনিসেফ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন মার্কেট ড্যাশবোর্ড। এতে আন্তর্জাতিকভাবে সব টিকার দাম উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশ সেখানে উল্লিখিত দামেই যে টিকা পেয়েছে, সেই বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই টিআইবির কাছে।

সরকার যে হিসাব দিয়েছে, তাতে ক্রয়, সংরক্ষণ, বিতরণ ও প্রয়োগ মিলিয়ে প্রতি টিকায় খরচ দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৩৫ টাকার কিছু বেশি। অন্যদিকে টিআইবি যে দাবি করেছে, তাতে খরচ হয় ৬০০ টাকার কিছু বেশি।

এই খরচের হিসাব বের করতে যে গবেষণা করা হয়েছে, তার গবেষক মোহাম্মদ জুলকারনাইন নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, তাদের তথ্য ‘অনুমাননির্ভর’। তিনি একাধিকবার এই কথাটি বলেছেন।

তবে গবেষকের এই বক্তব্যের বিপরীতে গিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন, তারা অনুমানভিত্তিক তথ্য দেননি, প্রকাশিত নানা তথ্যের ভিত্তিতেই কথা বলেছেন।

এখন পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে ২৯ কোটি ৬৪ লাখ টিকা, এর মধ্যে প্রয়োগ হয়ে গেছে ২৫ কোটির বেশি। অবশ্য এই টিকার সবগুলো সরকারকে কিনতে হয়নি। উপহার হিসেবেও এসেছে লাখ লাখ ডোজ।

গত ১২ এপ্রিল টিআইবি সংবাদ সম্মেলন করে গবেষণার ভিত্তিতে টিকার খরচের তথ্য পাওয়ার কথা জানালেও কীসের ভিত্তিতে খরচের হিসাব করা হয়েছে, সেই তথ্য জানানো হয়নি।

তবে গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিরোধী পক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে টিকার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে। আর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস কড়া সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘আমাদের খালি চোর বলবেন, এটা তামাশা পাইছেন নাকি আপনারা? শুধু বাংলাদেশকে চোর বলবেন, এটা কি ফাইজলামি নাকি?’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, যেহেতু কথা উঠেছে, তাই কিছু দিনের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

টিআইবির গবেষণায় তথ্য

গত ১২ এপ্রিল ‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে এই গবেষণা প্রকাশ করে টিআইবি। এই গবেষণায় সংস্থাটি দাবি করেছে, দেশে টিকা ক্রয় ও বিতরণে ১১ হাজার থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে টিকা বিতরণে কোভ্যাক্স রেডিনেস অ্যান্ড ডেলিভারি ওয়ার্কিং গ্রুপ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর টিকার পরিচালন ব্যয় সম্পর্কে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছে। টিকা কার্যক্রমের বিদ্যমান অবকাঠামো, জনবলের ব্যবহার এবং আউটরিচ কেন্দ্রের অনুপাত বিবেচনায় তারা প্রতি ডোজ টিকার একটি খচর নির্ধারণ করা হয়েছে।

সেই অনুয়ায়ী বিদ্যমান জনবল দিয়ে যদি কোনো দেশ টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে দশমিক ৮৪ ডলার খরচ হবে প্রতি টিকায়। আর যদি টিকার জন্য আর ১০ শতাংশ জনবল নিয়োগ করতে হয় এবং ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী টিকাকেন্দ্র যদি ৫০:৫০ হয় তাহলে ২ দশমিক ৬৪ ডলার পরিচালনা ব্যয় হতে পারে। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরলে টিকাপ্রতি ব্যয় হয় ২২৭ টাকা।

টিআইবি হিসাব করেছে, এভাবে টিকার ব্যবস্থাপনা খাতে খরচ হতে পারে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে যে টিকা আনা হয়েছে, সেটির দাম অনুমান করে ধরেছে ১১ হাজার ২৫৪ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ টিআইবি টিকাপ্রতি দাম ধরেছে সাড়ে পাঁচশ টাকার মতো, যা ৭ ডলারেরও কম।

আমরা অনুমান করেছি: টিআইবির গবেষক

টিআইবি কীভাবে সরকারের টিকা ক্রয় ও ব্যবস্থাপনা খাতে খরচের তথ্য পেল জানতে চাইলে গবেষক মোহাম্মদ জুলকারনাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটি এস্টিমেশন (আনুমানিক হিসাব) করেছি। তাতে দেখা গিয়েছে, ১১ হাজার কোটি থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে।’

অনুমানের ভিত্তিতে এত বড় অনিয়মের অভিযোগ আনা এই গবেষক বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করছি, আসলে কী কী বাবদ কত টাকা খরচ হয়েছে সেটা জনসম্মুখে প্রকাশ করলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। তবে এটা যে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়।’

অনুমানের ভিত্তি কী- এই প্রশ্নে টিআইবির গবেষক জুলকারনাইন বলেন, ‘টিকা কেনার সময় বিভিন্ন সোর্স থেকে টিকার যে দাম জানানো হয়েছে, সেটা নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক বা সেকেন্ডারি সোর্সের মাধ্যমে টিকা ক্রয়ে যে তথ্য পেয়েছি সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমার এস্টিমেশন তথ্য প্রকাশ করেছি।’

চীনের সিনোফার্ম থেকে দেশে বড় সংখ্যক টিকা আসছে, এই টিকার দাম প্রকাশ করেনি সরকার তাহলে আপনারা যে তথ্য প্রকাশ করেছেন সেই তথ্যের ভিত্তি কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ের সরকারের প্রকাশিত তথ্য এবং আমাদের প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি সোর্সের মাধ্যমে তথ্যে থেকে নেয়া হয়েছে। তবে এটা আমাদের এস্টিমেশন।’

গবেষক ও ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্য ভিন্ন

টিআইবির গবেষক তিন বার অনুমানের কথা উল্লেখ করলেও টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান দাবি করেছেন উল্টো। তিনি বলেন, ‘আমরা অনুমানের ভিত্তিতে কোনো তথ্য দেইনি। সিনোফার্ম টিকার দাম নির্ভরযোগ্য তথ্য থেকেই দিয়েছি।

‘যেহেতু সরকার টিকা ক্রয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যে দেয়নি। আমরা যেটা ম্যাক্সিমাম পসিবল আন্তর্জাতিক সোর্সের মাধ্যমে যে তথ্যগুলো সহজলভ্য সেই তথ্যেগুলো থেকে ক্যাটাগরি ভাগ করে তথ্য সংগ্রহ করেছি দামের তথ্য প্রকাশ করেছি।’

সেই তথ্যের উৎস কী?-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও কোভ্যাক্স রেডিনেস অ্যান্ড ডেলিভারি ওয়ার্কিং গ্রুপের টিকার বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় সম্পর্কে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছে, সেখান থেকে টিকা ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের তথ্য নেয়া হয়েছে। টিকা ক্রয়ে তথ্য নেয়া হয়েছে ইউনিসেফ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন মার্কেট ড্যাশবোর্ড থেকে। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে সব টিকার দাম উল্লেখ করা হয়েছে।

‘যেমন অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড টিকা ৫ ডলার, সিনোফার্মের ১০ ডলার, কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যে টিকা এসেছে এটা ৫ দশমিক ৫ ডলার দাম উল্লেখ করে হয়েছে। এসব দাম একসঙ্গে করে ম্যাক্সিমাম দাম ধরে হিসেব করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ টিকা কিনতে টাকা পে করেছে সেটাও করা হয়েছে ইউনিসেফ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন মার্কেট ড্যাশবোর্ডে।’

সিরামের টিকা ছিল কম মূল্যে, চীনের টিকার দাম অনেক বেশি

করোনার টিকা যখন ভারতীয় কোম্পানি সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা হয়, তখন সরকার তার ব্যয় প্রকাশ করেছিল। ৪ ডলার ভিত্তিমূল্য ধরে টিকা কেনা হয়। তবে এতে উল্লেখ ছিল, ভারত সরকার যে দরে টিকা কিনবে, সেটি যদি ৪ ডলারের কম হয়, তাহলে বাংলাদেশ সেই দামেই টিকা পাবে। আর যদি ভারত সরকার ৪ ডলারের বেশিতে টিকা কেনে, তাহলে বাংলাদেশ ৪ ডলারই দেবে। পরে এই কোম্পানিটি যখন টিকা সরবরাহে সফল হয়নি, তখন সরকার চুক্তি করে চীনের সঙ্গে।

প্রথমে জানানো হয়, চীনের টিকার দাম পড়ে সিরামের টিকার দ্বিগুণেরও বেশি, ১০ ডলার। তবে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর চীন টিকা চুক্তি বাতিলের হুমকি দেয়। কারণ, তারা অন্যান্য দেশে আরও বেশি দামে টিকা বিক্রি করেছে, বাংলাদেশকে তারা বিশেষ ছাড় দেয়। পরে চীনের শর্ত মেনেই টিকা কেনায় কত টাকা ব্যয়- এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

অবশ্য চীনের কাছ থেকে টিকা আসার পর বিশ্বজুড়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা জোট কোভ্যাক্স থেকে ভর্তুকি মূল্যে সরকার কোটি কোটি টিকা পেয়েছে। তবে টিকাপ্রতি ব্যয় কত, সেটি আর জানানো হয়নি।

চীনের কাছ থেকে টিকা কেনার সময় দাম ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারায় সে সময় সরকারের সমালোচনাও হয়েছে।

সরকার কী বলছে

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম প্রধান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকা ক্রয় এবং সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে মন্ত্রী যে হিসাব তুলে ধরেছেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কোন টিকা কী পরিমাণ দেশে আসছে এবং তার কত টাকা দান সেটা হিসাব একবারে পরিষ্কার। এখানে আড়াল করার কিছু নেই।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘যেহেতু স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথ্য দিয়েছেন, অবশ্যই সঠিক তথ্যই তিনি দিয়েছেন।’

টিকার ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করবেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’

তবে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান এই হিসাব প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশের বাইরে অবস্থা করছেন। তিনি দেশে ফিরলে এই বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারের অবস্থান তুলে ধরবেন।’

অনুমানের ভিত্তিতে টিআইবির এই হিসাব প্রকাশের বিষয়টি জানালে এ নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি মহাপরিচালক। তিনি বলেন, ‘টিআইবি যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক তথ্যের বরাত দিয়ে তথ্য দিয়েছে, এ বিষয়ে আমরা এখনই কোনো বক্তব্য দিতে চাই না। কিছু দিনের মধ্যে সরকারের জায়গা থেকে টিকা দামের সঠিক তথ্য জানানো হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর