কয়েকদিন আগেই উজানের ঢলে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওর এলাকায় পানি বেড়ে তলিয়ে গেছে হাজারও কৃষকের সারা বছরের ফসল। চোখের সামনেই ডুবে গেছে অনেকের জমি। দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। সেসময় অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার এই জমিগুলোর ধান কাঁচা ছিল। তাই কাঁচি হাতে নিয়ে ফসল কাটা শুরু করলেও কোনো লাভ হতো না।
ধীরে ধীরে পানি বেড়ে এখন মূল হাওরের জমিগুলোও হুমকির মুখে পড়েছে। অনেক জমির ধান কাটার মতো উপযোগী হলেও শ্রমিক সংকটে তা কাটতে পারছেন না কৃষকেরা।
কিশোরগঞ্জে পানির এমন চাপ শুরু হয়েছিল ৩ এপ্রিল। সে সময় ইটনা উপজেলার বিভিন্ন নদী তীরবর্তী চর ও খালে বিলে চাষ হওয়া নিচু জমিগুলো ডু্বতে শুরু করে।
এরপর থেকে থেমে থেমে পানি শুধু বেড়েই চলেছে। নিচু জমিগুলো তলিয়ে যাওয়ার পর বেশ কয়েকটি মূল হাওরের জমির ফসলও তলিয়ে গেছে।
কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলায় ৭৫০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা দাবি করছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। আর ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগই ইটনা উপজেলার।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইটনা সদর ইউনিয়নের জিওলের বাঁধ আর মৃগা ইউনিয়নের তেরাইল্ল্যের বাঁধ রক্ষায় দিনরাত বাঁধেই সময় কাটাচ্ছেন বিভিন্ন গ্রামের কৃষকেরা। জিওলের বাঁধের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি বিকল্প বাঁধ। কৃষকরা বলছেন, পানি যেভাবে বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে বাঁধ সুরক্ষিত থাকলেও বিভিন্ন দিক দিয়ে পানি প্রবেশ করে হাওর তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুক্রবার ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জল সাহা বলেন, ‘গত বুধবার ধনু নদীতে পানি বেড়েছে। এদিন রাতে এবং পরদিন সকালেও বৃষ্টি হয়েছে। আজকেও বৃষ্টি হয়েছে। এতে পানি বেড়েই চলেছে।’
তিনি জানান, বাঁধগুলো এখনও সুরক্ষিত থাকলেও পানির চাপ বাড়তে থাকায় বিভিন্ন দিক দিয়ে অল্প অল্প করে হাওরে পানি প্রবেশ করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূল হাওরে এখনও পানি ঢুকেনি। বাঁধগুলোও ঠিক আছে। আমাদের লোকজন সার্বক্ষণিক হাওরে থেকে কাজ করছে। আর কৃষকদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি, তারা যেন দ্রুত তাদের জমির ফসল কেটে ঘরে তুলে নেন।’
কৃষি অফিস বলছে, যাদের জমির ধান ৭০-৮০ ভাগ পেকে গেছে তাদের ফসল দ্রুত কেটে নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
কিন্তু কৃষি অফিসের এমন অনুরোধ থাকলেও ইতোমধ্যেই হাওরগুলোতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কৃষকেরা হন্যে হয়ে ধান কাটার শ্রমিক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ শ্রমিকই এখন নিজের জমির ফসল তোলা নিয়ে ব্যস্ত।
মৃগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দারুল ইসলাম বলেন, ‘হাওরের বেশিরভাগ জমির ফসল এখনও আধাপাকা। তারপরও ফসলহানির ভয়ে এই অবস্থায়ও ধান কাটছেন অনেকে।’
তিনি জানান, হাওরের ফসলি জমির ধান কাটার শ্রমিক আসে বিভিন্ন জেলা থেকে। অন্যান্য বছর টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ আর সিরাজগঞ্জ থেকে যে পরিমাণ শ্রমিক হাওরে ধান কাটতে আসেন সে তুলনায় এবার কম এসেছেন।
দারুল ইসলাম বলেন, ‘আবহাওয়া ভালো না থাকায় এবং জমিতে পানি ঢুকে যাওয়ার ফলে আধাপাকা ভেজা ধানে একদিনের কাজ তিনদিন সময় লাগছে। ফলে স্থানীয় শ্রমিকরা গত বছর যে মুজুরি নিয়েছেন এবার তার দ্বিগুণ দাবি করছেন।’
চলতি মাসের শুরুর দিকে হঠাৎ পানি চলে আসায় অপেক্ষাকৃত নিচু জমিগুলো তলিয়ে যেতে শুরু করে
ইটনা সদর ইউনিয়নের কৃষক আসাদ মিয়া বলেন, ‘পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে জমির ফসল যতটুকুই পেঁকেছে কেটে ফেলা দরকার। কিন্তু লোক না থাকায় আমরা বিপদে পড়েছি। স্থানীয় যেসব লোক ধান কাটে তারা মূলত নিজের খোরাকের জন্য চাষ করা জমির ফসল তুলে অতিরিক্ত সময়টিতে অন্যের জমিতে কাজ করে। কিন্তু এবার তো সবাই নিজেরটা নিয়েই ভয়ে আছে।’
জয়সিদ্দি গ্রামের কৃষক মুক্তাদির ইবনে মান্নান। ৩৫ একর জমি চাষ করেছেন তিনি। শ্রমিক সংকটে ভুগছেন তিনিও।
মুক্তাদির বলেন, ‘টাঙ্গাইল থেকে যে পরিমাণ শ্রমিক আসার কথা তার চেয়ে এবার কম এসেছেন। বর্তমানে স্থানীয় যেসব শ্রমিক আছে তাদের দিয়ে কৃষকদের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না।’
মুক্তাদির জানান, সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ধান কাটার মেশিন এলাকায় থাকলেও জমিতে পানি ঢুকে গেলে সেগুলোও অচল হয়ে পড়বে।
রায়টুটী ইউনিয়নের কৃষক মাহিন মিল্কী জানান, অন্যান্য বছর বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটার যে শ্রমিকেরা আসতেন এবার পানির খবর শুনে তারা অনেকেই আসেননি।
তিনি বলেন, ‘শুকনা থাকা অবস্থায় যে জমির ধান কাটতে শ্রমিক লাগে ১০ জন, জমিতে পানি থাকার কারণে সেখানে শ্রমিক প্রয়োজন হচ্ছে ২০-থেকে ৩০ জন। আর শুকনা থাকলে জমির ধান কেটে সরাসরি খলায় নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু ভেজা থাকায় সে ধান খলায় নিতে একটানার কাজ তিনটানা লাগছে। পানিতে নেমে ধান কাটায় মুজুরিও বেশি লাগছে।’
এলংজুরী ইউনিয়নের ছিলনী গ্রামের কৃষক মামুন মিয়া ২২ একর জমি চাষ করেছেন। শ্রমিক সংকটের জন্য তিনি নিজে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকদের বাড়িতে গেছেন। অন্য বছরের তুলনায় এবার বাড়তি ধানও দেয়ার প্রস্তাব দিলেও শ্রমিকরা আসতে রাজি হননি।
মামুন বলেন, ‘গতকালও তাদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছি। বাড়তি টাকার প্রস্তাবে রাজি হয়েও পানির খবর শুনে তারা ঘুরে গেছেন। আর স্থানীয় যেসব শ্রমিক আছেন তাদের নিয়ে এখন সবার টানাটানি।’
একই গ্রামের ধান কাটা শ্রমিক শামীম মিয়া। গ্রামের উঠতি বয়সী কিছু যুবককে নিয়ে একটি জোগাল (শ্রমিকের দল) গঠন করেছেন। তিনি জানান, দলের লোকসংখ্যা কম। বিপরীতে লোকের চাহিদা অনেক বেশি। এ অবস্থায় অনেক আগে থেকে যেসব কৃষক বলে রেখেছেন, তাদের সিরিয়াল দেয়া আছে। তাই বর্তমানে অনেকে ধান কাটার প্রস্তাব নিয়ে আসলেও তাদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
শামীমের জোগাল ছাড়াও ওই গ্রামে আরও বেশ কয়েকটি জোগাল রয়েছে। তারাও পুরোদমে ব্যস্ত ধান কাটায়।
শামীম বলেন, ‘বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক না আসলে স্থানীয় শ্রমিকরা ১০০ ভাগের ১০ ভাগ জমিও কেটে শেষ করতে পারবে না।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১৩ উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওরেই রয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ছাইফুল আলম জানান, কিশোরগঞ্জ জেলায় এখন পর্যন্ত ৪৩ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে।ধান কাটার জন্য কৃষকদের এ পর্যন্ত ২২৮টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও ২২টি রিপার মেশিন দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আশা করি, শ্রমিক সংকট কেটে যাবে। পুরো হাওরের ধান কাটা হতে শেষ হতে আরও ১৫ দিন সময় লাগতে পারে।’