বাগেরহাটের শিশু আরিয়ান রহমান আলভি ‘ভাত খাওয়ার চাল কিনতে শাক বিক্রি করছে’- এমন একটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অন্তত দুটি সংবাদমাধ্যমে আরিয়ানকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বৃহস্পতিবার। এতে দাবি করা হয়, মায়ের জন্য চাল কিনতে আরিয়ান গ্রাম থেকে বাগেরহাট শহরে এসেছিল গত মঙ্গলবার। অভাবের কারণে কয়েক দিন ধরে ইফতারের সময় সে তার মাকে পানি ছাড়া আর কিছুই খেতে দেখেনি।
একটি সংবাদমাধ্যম কেবল আরিয়ানের বক্তব্য ধরেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আরেকটিতে তার মা ও স্থানীয় এক শিক্ষার্থীর বক্তব্য রয়েছে। তবে তাদের বক্তব্যে অভাবের প্রসঙ্গ থাকলেও চাল কেনার প্রয়োজনে আরিয়ানের শাক বিক্রিতে নামার বিষয়ে কোনো কথা পাওয়া যায়নি।
আরিয়ানের পরিবারের অবস্থা জানতে তার গ্রামে শুক্রবার দিনভর অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। শিশুটি এবং তার মায়ের পাশাপাশি কথা হয়েছে অন্য স্বজন, গ্রামবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে। এতে আরিয়ান ও তার মায়ের না খেয়ে থাকার দাবির কোনো সত্যতা মেলেনি।
আরিয়ানের নানাসহ স্থানীয়দের পাল্টা দাবি, আরিয়ানের মা কোনো ধরনের কাজ না করে সবার কাছে চেয়েচিন্তে খেতেই আগ্রহী।
সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর শুক্রবার প্রশাসনসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে আরিয়ানের পরিবার বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেয়েছে। তাদের আরও সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
নিউজবাংলার অনুসন্ধান
বাগেরহাট সদর উপজেলার গোটাপাড়া ইউনিয়নের ভাটশালা গ্রামে মা আমেনা আক্তার পিয়ার সঙ্গে থাকে সাত বছরের আরিয়ান। ভাটশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ছে শিশুটি।
আরিয়ানের বিষয়ে জানতে নিউজবাংলার প্রতিনিধি শুক্রবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভাটশালা গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কথা হয়েছে আরিয়ান ও তার মা এবং অন্য স্বজনের সঙ্গে।
প্রতিবেশীরা জানান, অল্প বয়সে আমেনার বিয়ে হয় দুইবার। দ্বিতীয় স্বামী খলিলুর রহমানের সংসারে আরিয়ানের জন্ম হয়। তবে কলহের জেরে আমেনা ছোট্ট আরিয়ানকে নিয়ে বছর চারেক আগে বাবা সাইকুল ইসলামের বাড়িতে ফিরে আসেন।
সাইকুল বাগেরহাট সদরে দিনমজুরের কাজ করেন। ভাটশালা গ্রামে তার ১০ শতাংশ জমি ও আড়াই বিঘা ধানি জমি আছে। ধানি জমিতে আছে মাছের ঘের। আর ওই ১০ শতাংশ জমিতে আছে দুটি ঘর।
একটি ঘরে তৃতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানদের নিয়ে থাকেন সাইকুল। পাশের ঘরে থাকেন সাইকুলের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের সন্তান আমেনা ও তার ছেলে আরিয়ান।
মা আমেনা আক্তার পিয়ার সঙ্গে শিশু আরিয়ান। ছবি: নিউজবাংলাসাইকুল নিউজবাংলাকে জানান, তার প্রথম স্ত্রী অসুস্থ হয়ে মারা যান। সেই পক্ষের একটি ছেলেও ছোটবেলায় মারা যায়। এরপর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন; সেই সংসারে আমেনাসহ দুই ছেলে ও তিন মেয়ে হয়। সাইকুলের দ্বিতীয় স্ত্রীও মারা যান অসুস্থতায়। এরপর তিনি রিনা বেগমকে বিয়ে করেন। এই ঘরে তার দুই মেয়ে রয়েছে।
সাইকুল জানান, তার ছেলেমেয়েদের প্রায় সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ভাটশালা গ্রামের বাড়িতে তার সঙ্গে থাকেন তৃতীয় স্ত্রী রিনা বেগম, তার এক মেয়ে, এক ছেলে ও দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান আমেনা ও নাতি আরিয়ান।
সৎ-মা রিনাকে নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে আমেনার। তিনি দাবি করেন, সৎ-মায়ের কারণেই ছোট বয়সে বয়স্ক একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেখানে অত্যাচার করা হতো বলে তিনি পালিয়ে ঢাকা যান। সেখানে খলিল নামে একজনকে বিয়ে করেন। খলিল মারধর করায় ১৫ দিনের মাথায় বের হয়ে একটি কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে চলে যান আমেনা।
আমেনা জানান, ওই কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রেই আরিয়ানের জন্ম। এরপর বিভিন্নজনের মাধ্যমে সমঝোতায় খলিলের সংসারে ফেরেন। তবে শ্বশুরবাড়ি রংপুর গিয়ে দেখেন খলিলের আগেও কয়েকজন স্ত্রী রয়েছে। সতিনরা তাকে অত্যাচার করত বলে ২০১৮ সালে আরিয়ানকে নিয়ে তিনি বাবার বাড়ি চলে আসেন।
আমেনার অভিযোগ, সৎ-মা তাকে খেতে দেয় না। বাবা কিছু চাল-ডাল দেয়, তবে হাঁড়িপাতিল, রান্নাঘর নেই বলে রান্না করতে পারেন না।
আমেনা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘না খেয়ে থাকি। আমার ছেলেটাকে দিয়ে সবাই কাজ করায়, মারধর করে। তাই ছেলেকে কাজ করতে দিই না। আমি এদিক-ওদিক থেকে যা পারি এনে খাই। ছেলেটা তো ঘরে থাকে না, তাকে কীভাবে খাওয়াব। সে খালি বাইরে-বাইরে ঘোরে।’
আরিয়ান স্কুলেও নিয়মিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা আগে ভালো ছিল। এখানে আসার পর গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে গেছে। আমার কোনো কথা শোনে না। লোকে তাকে দিয়ে কাজ করায়, মারধর করে। আমি কোথাও যেতে মানা করি। সে কথা শোনে না, ঘরেই থাকে না।
আরিয়ানের নানা সাইকুল ইসলামের বাড়ি। ছবি: নিউজবাংলা‘আমার ছেলেটা অবাধ্য হয়ে গেছে। তাকে সবাই শিখায় দেয় মাকে গিয়ে মার, সে আমাকে মারতে আসে। তাকে খারাপ খারাপ কথা শেখায়।’
বাবার দেয়া চাল-ডাল রান্না না করার কারণ হিসেবে আমেনার দাবি, 'আমার রান্নাঘর নাই, চুলা নাই।'
আরিয়ানের বাবা মাঝে মাঝে টাকা পাঠান বলেও জানান আমেনা।
তবে আমেনার বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ তার বাবার। রান্নাঘর প্রসঙ্গে সাইকুল নিউজবাংলাকে বলেন, 'ঘর তুলে দেয়ার পর পাশে রান্নাঘরের জন্য আমিই মাটি কেটে জায়গা করে দিয়েছি। কিন্তু আমেনা সেখানে চুলা বানায় না। আমাদের রান্নাঘরেও তার রান্না করার সুযোগ আছে, সেখানেও রান্না করে না।'
সাইকুল বলেন, 'ওর (আমেনা) অনাহারে থাকার বিষয়টি সত্য না। আমেনা কোনো কাজ করতে চায় না, বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা-খাবার চেয়ে নেয়।
‘চাল-ডাল-মাছ-তরকারি তো ঘরে থাকেই, সে (আমেনা) রান্না করে খায় না। ছেলে যা শেখায় মা বলে, মা যা শেখায় ছেলে বলে। চাল তো ওর ঘরেই আছে, না থাকলে আমি দিই। অনেক সময় না থাকলে তো আমাকে বলে। আমি আমার খাবারও তাকে দিই, আমি না খেয়ে থাকি।'
সাইকুল জানান, আগে তার একটিই ঘর ছিল। সেখানে তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন। আমেনা সন্তানসহ চলে আসার পর ঘরের বারান্দার অংশে তাকে থাকতে দেয়া হয়। তবে সৎ-মায়ের সঙ্গে কলহের কারণে পরে আরেকটি ঘর তুলে দেয়া হয়।
আমেনা মাঝে মাঝে শাক তুলে বিক্রি করেন জানিয়ে সাইকুল বলেন, 'এর বাইরে ও আর কোনো কাজ করে না।
‘টাকা-পয়সা যা হাতে ছিল, তা দিয়ে ওই ঘর তুলে দিয়েছি। ভেবেছিলাম নিজের ঘরে থাকুক। সে (আমেনা) এদিক-ওদিক যায়, শাকপাতা বিক্রি করে। আমি যা পারি দিই। নাতি এসে বলে, ও নানা ৫০ টাকা দাও, ১০০ টাকা দাও, আমি দিই।’
আমেনার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তার সৎ-মা রিনা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একসঙ্গে থাকার সময় আমার কোনো কথা শুনত না, যা বলতাম উল্টোটা করত। কোনো কাজকর্ম করত না। এদিক-ওদিক গিয়ে শুধু অতিরিক্ত কথা বলত। পরে সবাই বলায় তাকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। এখন সে তার মতো থাকে।’
শিশু আরিয়ানকে নিয়ে এই ঘরে থাকেন আমেনা। ছবি: নিউজবাংলাআমেনাদের না খেয়ে থাকার দাবি সত্যি নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সে (আমেনা) তো এদিক-ওদিক থেকে চেয়ে এনে খায়। সারা দিন ঘোরে, সন্ধ্যায় ভাত-তরকারি জোগাড় করে এনে খায়। কোনো দিন তো রান্না করে না। এই এত চাল-ডাল দিচ্ছে সবাই, কিছুই রান্না করে না। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চেয়ে খাবে, কাজ করবে না।’
আমেনা ও তার স্বজনের সঙ্গে কথা বলার সময় স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে একের পর এক সহায়তা আসতে দেখা যায়। সেগুলো গুছিয়ে ঘরে তুলছিলেন আমেনা। এরই মধ্যে এক নারী এসে কিছু খাবারের প্যাকেট ও একটি ফোন দিয়ে যান। তবে সেই ফোন মায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় আরিয়ান।
আমেনা বারবার ফোন ফিরিয়ে দিতে চাইলেও কান দেয়নি আরিয়ান। ক্ষুব্ধ আমেনা এ সময় নিউজবাংলা প্রতিনিধিকে বলেন, ‘দেখলেন তো, কোনো কথা শোনে না। বারবার বলছি, মোবাইলটা দাও, ব্যাক দেয় না।’
দিনভর বিভিন্ন সংবাদকর্মীদের আনাগোনা ছিল আরিয়ানের বাড়িতে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত দেখা যায় শিশুটিকে। বিকেলে তার সঙ্গে কথা বলেন নিউজবাংলা প্রতিনিধি।
চালের জন্য শাক বিক্রির বিষয়ে কোনো পরিষ্কার কথা পাওয়া যায়নি শিশুটির। কেন সে বাগেরহাট শহরে গিয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তরও ছিল এলোমেলো।
প্রতিবেশীরা জানান, আমেনা কোথাও কাজ করতে চান না। তিনি অস্থির প্রকৃতির।
ভাটশালা গ্রামের আমিনুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেন যে কাজ করে না জানি না। হয়তো কোনো শারীরিক সমস্যা বা মানসিক সমস্যার কারণে সে কাজ করতে চায় না।’
আমেনাদের বাড়ির কাছেই ইমদাদুল হকের দোকান। তিনি জানান, আরিয়ান তার দোকানে মাঝে মাঝে টুকটাক কাজ করে। এর বিনিময়ে টাকা দিলে আমেনাও এসে টাকা চান।
ইমদাদ বলেন, ‘ওর মা (আমেনা) কিন্তু ছেলেকেও খেতে দেয় না। একটু যদি কাজ করে, তাহলে বাধা দিয়ে বলে তোর কাজ করতে হবে না। ছেলে যদি কিছু কামাই করে তাহলে বলে ওই টাকা আমারে দে। কোনো রান্না কিন্তু করে না।
‘ছোট মানুষ এটা-সেটা বিক্রি করে, যা পায় তা দিয়ে মাঝে মাঝে চাল-ডাল কেনে, বন্দুক (খেলনা) কেনে, হাবিজাবি কিনে খায়। কোথাও কোনো কাজ করতে দিলে ওর মা এসে দাবি করে ছেলের পাশাপাশি তাকেও টাকা বা খাবার দিতে হবে।’
আরিয়ানের স্কুল ভাটশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সজল চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছেলেটা ইররেগুলার, স্কুলে নিয়মিত আসে না। সে দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার পরিবার দরিদ্র হওয়ায় স্কুলের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগে ৫০০ টাকা ছেলেটার হাতে দিই।
‘করোনার পর স্কুল খোলা হলে মাস তিনেক আগে স্কুলের মনিটরিং কমিটির পক্ষ থেকে প্রধান শিক্ষক ও আমি আরিয়ানের বাড়িতে যাই। তার মাকে অনুরোধ করি তাকে স্কুলে পাঠাতে। সহায়তার আশ্বাসও দিই। তবে সে স্কুলে ঠিকমতো আসে না।’
হতদরিদ্রদের জন্য সরকারি সহায়তা আমেনা কেন পাননি, তাও জানতে চেয়েছে নিউজবাংলা। এ বিষয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মনিরুল ইসলাম তরফদার বলেন, ‘তার (আমেনা) তো ন্যাশনাল আইডি কার্ড নাই। সবকিছুতেই তো আইডি কার্ডের নম্বরটা লাগে।'
আমেনাকে সরকারি সহায়তা দেয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ১০ কেজি করে চাল তাকে দিয়েছি। ইউএনও মহোদয় এসেছিলেন, আইডি কার্ডের বিষয়ে কথা হয়েছে। যত দ্রুত পারি কার্ডের ব্যবস্থা করব।’
সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমপির নির্দেশে আমরা আরিয়ানকে নিয়ে গিয়ে তার যা যা পছন্দ কিনে দিয়েছি। তার মায়ের জন্য কাপড় কিনে দিয়েছি। খাবার কিনে দিয়েছি। তাদের জন্য যা যা প্রয়োজন করা হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আরিয়ানের বিষয়ে খবর দেখেই এমপি মহোদয় ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করে গতকাল ও আজ খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছেন। আমেনাকে চাকরি দেয়ার প্রস্তাবও আসছে।
‘আমেনা এ প্রস্তাব (চাকরি) ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা আরিয়ানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার নামেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে সেখানে সহযোগিতাগুলো জমা করার বিষয়টি কো-অর্ডিনেট করছি।’
ইউএনও জানান, আমেনা চাইলে তার জন্য পৈতৃক জমিতে ঘর তুলে দেয়া যেতে পারে। ভূমিহীনদের জন্য যে খাসজমি আছে, সেটিও দেয়া যেতে পারে।