ফসল ভালো হয়েছিল। কিছুদিন পরেই ধান কাটার কথা ছিল। সেই ফসল দিয়েই ঋণমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক কৃষক।
গত মঙ্গলবারের মাত্র এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে শেরপুর জেলা সদর, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার অনেক কৃষকের।
কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, শেরপুর জেলায় চলতি মওসুমে ৯১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের আবাদ করেছেন কৃষকরা। ১৯ এপ্রিল ভোরে এক ঘণ্টার ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে শেরপুর সদর, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার প্রায় দুই হাজার কৃষকের স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
এ এলাকার ১ হাজার ২০০ একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে আরও ৮০০ একর জমির বোরো ধান।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শ্রীবরদী উপজেলার কুরুয়া, কুড়িকাহনিয়া, মাটিয়াকুড়া, জঙ্গলখিলা, বাদে ঘোনাপাড়া, ধাতুয়া, জালকাটা, ষাইটকাকড়া, দক্ষিণ মাটিয়াকুড়ায় শিলাবৃষ্টি ও বৈশাখী ঝড়ে ধান, শসা, ডাটা, কলাবাগান, কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে ঘর-বাড়ি, ছিদ্র হয়েছে বাড়ির টিনের চাল।
কুড়িকাহনিয়া ইউনিয়নের করুয়া ভাটিপাড়ার কৃষক মগর আলী বলেন, ‘আমার সব শেষ। ধান পাইক্কা গেছিল। সারা বছরের চলার শক্তি শেষ। হিলে (শিলা বৃষ্টি) আমার কিছুই থুইয়া যাই নাই। কি খামু, পোলাপান কি খাবো।
‘আমি ঋণ কইরা ধান লাগাইছিলাম। ঋণের টাহা চাবার আইলে মাথাত বাড়ি দিতে হবো। আল্লাহ তুমি জানো।’
নষ্ট ধান কাটছেন কৃষকরা। ছবি: নিউজবাংলা
কৃষক কুরুয়ার আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমি তিন একর জমির ধান লাগাইছিলাম। আমার কিছুই নাই। ধানে ক্ষেতের যি অবস্থা গরুও খাবো না। হিলে ধান গাছ থেঁতলা গেছে। সব ধান মাটিত ছিইড়া পইড়া আছে। এখন নিজে কিবা কইরা চলমু আর গরু-বাছুররেই কি খাওয়াইমু। মহাজনদের কাছ থাইক্কা ঋণ নিয়া চাষ করছিলাম এহন তাদের ঋণ কিবাই দিমু।’
কৃষক জয়নাল মিয়া বলেন, ‘আমি দেড় একর জমিত ধান লাগাইছিলাম। ফলন তো বালাই হইছিল। শিলে আমারতো সব শেষ। আমরা এক সিজন আবাদ করে সংসার চালাই।
‘এইডা নামা জায়গা। এল্লা (অল্প) বৃষ্টি হইলেই পানি ওডে। কয়দিন পরেই ধান কাটতাম। সব তো শেষ হয়ে গেল। এহন পোলাপানের লেহাপড়ার খরচ কী দিয়া চালামু।’
গোশালপুরের কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, ‘আমার জমির ধান জিবা (যেভাবে) কইরা নষ্ট হইছে, গরুও খাইনা দিলে। আর ধান তো নাই। তাই কাইটা বাড়িত নিয়া যাই। পরে তো ক্ষেতে থাকলে পইচ্চা নষ্ট হবো। কোনো কামই হবো না।’
এসব এলাকার অনেক কৃষক পরিবারের ঘরের চালের টিন শিলা বৃষ্টিতে ছিদ্র হয়ে পড়া ঘরে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে মাঠের ফসল নষ্ট, অন্যদিকে বাড়ি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
শিলাবৃষ্টিতে অনেক কৃষকের ঘরের টিন নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি: নিউজবাংলা
কুড়িকাহনিয়ার কৃষক শাহাদাৎ আলী বলেন, ‘আমার ঘরের চালে এত বড়বড় হিল পরছে যে শিলাবৃষ্টির দিন চকির নিচে গিয়ে জীবন বাচাইছি। এখন খোলা আকাশের নিচে থাকা লাগতাছে। এল্লা মেঘ আইলেই পানি পরে। আমগর দিহি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি দেক।’
মোবারকপুরের করিম মিয়া বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমরা দিন আনি দিন খাই। ওই দিন ভোররাতে শিল পইরা আমগর এলাকার মেলা জনের টিনের চাল শেষ। কী করমু এহন।
‘আমগর তো টাহাও নাই যে নতুন টিন কিইন্না লাগামু। সরকারের কাছে সাহায্য চাই।’
শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মুহিদ কুমার দে বলেন, ‘কৃষকরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। এ মূহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে আউশ ধান রোপন করার পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। যাতে তারা কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন।
‘দ্রুত বীজতলা তৈরি করে আউশের বীজ বোপন করা যেতে পারে। এখন আমরা তাদেরকে বীজের ব্যবস্থা করে দেবো। যেসব জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানে পটাশ অথবা ছত্রাকনাশক ওষুধ দেয়ার মাধ্যমে কিছুটা ফল পাওয়া যেতে পারে। আর পরবর্তীতে আমন রোপন করতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করব।’
শেরপুর জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশিদ বলেন, ‘শ্রীবরদী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ত্রাণ বিতরণসহ তাদের পাশে দাঁড়াতে আর্থিক সহায়তা ও ঢেউটিন প্রদানের জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছি।’