যে দুই ফাস্টফুডের দোকানের কর্মচারীদের বিবাদে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল গোটা নিউ মার্কেট এলাকা, তার মালিক ও ভাড়াটিয়ারা একই পরিবারের সদস্য।
সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ সূত্রে ওয়েলকাম ফাস্টফুড ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামের দোকান দুটির মালিক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য মকবুল হোসেন সরদার ও তার স্ত্রী।
ওয়েলকাম ফাস্টফুড নামের দোকানটি চালান মকবুলের ছোট ভাই রফিক হোসেন সরদার। আর ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামের দোকানটি পরিচালনা করেন মকবুল ও রফিকের চাচাতো ভাই শহিদুল হোসেন সরদার।
শহিদুল ও রফিকের দুই দোকানের কর্মচারীদের বিবাদের জেরে এমন সংঘর্ষকে সহজভাবে দেখেননি গোয়েন্দারা। তাই তারা শুরুতেই এই সংঘাতে রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয়ে ছায়াতদন্ত চালায়। এরপর রিপোর্ট অনুযায়ী মামলায় আসামিদের নাম যুক্ত করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা দুই দোকানের কর্মচারীদের বিবাদের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করি। নিশ্চিত হই শুরুতে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু ছিল না। এটা নিছক কর্মচারীদের নিজেদের শক্তি প্রদর্শন ও আত্মরক্ষার জন্য মারামারি। তখন এক পক্ষের হয়ে এতে জড়িয়ে যায় ঢাকা কলেজের ছাত্ররা, কিন্তু ছাত্ররা মার খেয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে নিউ মার্কেটে হামলা চালালেও সেটা কিন্তু অল্প সময়ে চুকে যায়।
‘তারা ২ নম্বর গেটে কিছুটা ভাঙচুর করে আবার সরে যায়। একই সময় নিউ মার্কেট মালিক সমিতির সদস্যরা ছুটে এসে নিউ মার্কেটের ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেন। কলেজের ছাত্ররাও আর নিউ মার্কেটের ভেতরে কোনো ভাঙচুর করেননি।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ছাত্রদের রাগ ছিল নিউ মার্কেটের ওপর। তারা কিছুটা ভাঙচুর চালিয়ে বাইরে চলে গেলেন। এটা এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কারণ নিউ মার্কেট থেকে তখন কেউ ছাত্রদের পাল্টা হামলা করেনি, কিন্তু নিউ মার্কেটের বাইরে অন্যান্য মার্কেট ও ফুটপাতের হকারদের মধ্যে এই উত্তেজনা ছড়াল কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখলাম, ঠিক এই সময়টা থেকেই ঘটনাটি রাজনৈতিক রূপ পেল।
‘পরবর্তী সময়ে সংঘর্ষ চলমান রাখতে ব্যবসায়ী-ছাত্র উভয় পক্ষকে উসকে গেছে রাজনৈতিক পক্ষটি। আর এই কাজটি যারা করেছে তাদের নামই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা মকবুল হেসেন সরদার জানান, তার দুই দোকান দুই ভাইয়ের কাছে ১৫ বছর ধরে ভাড়া দেয়া। ওয়েলকাম ফাস্টফুড আপন ভাই রফিক হেসেন সরদার আর ক্যাপিটাল ফাস্টফুড চাচাতো ভাই শহিদুল হোসেন সরদারের কাছে ভাড়া দিয়েছেন তিনি, তবে তিনি নিজে রাজনীতি করলেও তার দুই ভাই কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
মকবুল বলেন, ‘সেদিন কর্মীদের মারামারির ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভাইয়েরা ফোনে আমাকে বিষয়টি জানালে মার্কেটের সভাপতিকে তা জানাই আর মীমাংসা করে দেয়ার অনুরোধ করি। এরপর তারা নিউ মার্কেটের ভেতরটা কন্ট্রোল করে ফেলে। পরে মার্কেটের বাইরে কারা কারা, কীভাবে সংঘর্ষে জড়াল, সেটা আমার জানা নেই। কারণ আমি সেখানে ছিলামই না।
‘গত ৪ মাস আমি আমার ওকালতি পেশা নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি; একবারের জন্যও মার্কেটে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।’
শুধু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেই তাকে ফাঁসাতে মামলা দেয়া হয়েছে দাবি করে মকবুল বলেন, ‘পুরো ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আপনারা প্রচার করেছেন। এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কারা এই গণ্ডগোল শুরু করল। এখন নিজেদের ছেলেদের বাঁচাতে আমাদের ফাঁসাচ্ছে সরকার।’
এ বিষয়ে ঢাকা নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি যখন এই ঘটনার খবর পাই, তখন বাসার পথে ছিলাম। খবর পেয়েই গাড়ি ঘুরিয়ে মার্কেটে আসতে আসতে দেখি মার্কেটের ভেতরে গণ্ডগোল চলছে, তবে কিছুক্ষণ পর ছাত্ররা চলে গেলে আমরা সব গেট বন্ধ করে মার্কেট সিকিউর করি। মার্কেটের বাইরে কী হয়েছে, সেটা আমাদের জানা নেই।’
গত সোমবার মধ্যরাতে নিউ মার্কেটের দোকানমালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এর জেরে মঙ্গলবার দিনভর ওই এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের রেশ থাকে বুধবার পর্যন্ত।
ওই সংঘর্ষে একজন ডেলিভারিম্যান ও এক দোকান কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক।
সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন ১৫ জনের মতো সাংবাদিক।