বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লঞ্চের কেবিনবয় থেকে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী

  •    
  • ২২ এপ্রিল, ২০২২ ০১:২৮

স্বজনরা জানান, মামুনের বাবা প্রায় ৩০ বছর আগে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে সন্তানদের নিয়ে পটুয়াখালী শহরে চলে যান। এরপর ওই বাড়িতে মামুন ছাড়া পরিবারের আর কেউ আসা-যাওয়া করেনি। মামুন টুপি পরে একটি সাদা প্রাইভেট কারে আবার কখনও পাজেরো জিপে গ্রামে এসে ঘুরে বেড়াতো। ওই গাড়ির সামনে বড় করে লেখা থাকতো- পুলিশ।

প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরুনো হয়নি মো. মামুন মাদবর ওরফে ল্যাংড়া মামুনের। অভাবের তাড়নায় মা-বাবা গ্রাম ছাড়েন। তাদের সঙ্গে পটুয়াখালী শহরে এসে বসবাস শুরু করে মামুন। এক পর্যায়ে সংসারের হাল ধরতে ছোট্ট ছেলেটি বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা-পটুয়াখালী নৌ-রুটের লঞ্চে কেবিন বয়ের কাজ শুরু করে।

বড় ভাই মিজান মাদবর ওরফে রং মিজানের সহায়তায় মামুনের ঢাকায় আসা। এখানে ছোটখাটো বিভিন্ন বাহিনীর সংস্পর্শে আসে সে। শুরু হয় অপরাধ কর্মকাণ্ড। প্রথমেই সে রাজধানীর এক সময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের সঙ্গ পায় সে। পরবর্তীতে ভিড়ে যায় লেদার লিটনের দলে। নিজেই হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী।

পটুয়াখালীর হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে মামুন এবার জড়িয়ে পড়েন মাদকের কারবার, অপহরণ ও ব্যাংক ডাকাতির মতো ঘটনায়। রাজধানীতে এমনই এক অপকর্ম চালাতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে আহত হন তিনি। গুলি লাগা তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়। পরবর্তীতে সার্জারি করে কৃত্রিম পা লাগানো হয়। একইসঙ্গে পরিচিতি মেলে ল্যাংড়া মামুন নামে।

পটুয়াখালীর বড় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার শিবু লাল দাসকে অপহরণের ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে এই সন্ত্রাসীর নাম। ওই ঘটনায় ১৯ এপ্রিল ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

বরগুনার আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ টেপুরা গ্রামের এই মাদবর বাড়িতে মামুনের জন্ম। ছবি: নিউজবাংলা

এক পা হারিয়ে শারীরিক সক্ষমতা কমলেও অপরাধ কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি ল্যাংড়া মামুনের। বরং অপরাধ জগতে নতুন করে বিচরণ শুরু হয় তার। পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন মাদক কারবারে। কৃত্রিম পায়ের ভেতরের ফাঁপা অংশে ইয়াবা বহন করে ইয়াবা বেচাকেনা চালাতে থাকেন।

পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ৫৬ কিলোমিটার দক্ষিণে পটুয়াখালী-বরগুনার সীমান্তবর্তী এলাকায় মামুনের গ্রামের বাড়িতে বৃহস্পতিবার দিনভর খোঁজখবর নিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালি ইউনিয়নের পরই বরগুনার আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়ন। হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ টেপুরা গ্রামের মাদবর বাড়িতে মামুনের জন্ম।

আত্মীয়-স্বজনরা জানান, প্রায় ৩০ বছর আগে মামুনের বয়স আনুমানিক যখন ছয় থেকে সাত বছর তখনই অভাবের তাড়নায় ভাগের সব জমি এমনকি ভিটেবাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে সন্তানদের নিয়ে পটুয়াখালী শহরে চলে যায় ওর মা-বাবা। এরপর ওই বাড়িতে মামুন ছাড়া তার পরিবারের আর কেউ কখনও আসা-যাওয়া করেনি। মামুন টুপি পরে একটি সাদা প্রাইভেট কারে আবার কখনও পাজেরো গাড়িতে করে গ্রামে এসে ঘুরে বেড়াতো। তখন ওই গাড়ির সামনে বড় অক্ষরে পুলিশ লেখা থাকত।

মামুনের বড় ভাই মিজানেরও গত দশ বছর ধরে কোনো খোঁজ নেই। একটি অপহরণ মামলায় জেলে যাওয়ার পর জামিনে বের হওয়ার পর পিস্তল ঠেকিয়ে ছোট ভাই মামুনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়ার পর থেকে মিজানের আর দেখা মেলেনি। মামুন ছাড়া আর কেউ মিজানের খবর জানে না- এমনটা দাবি আত্মীয়-স্বজনদের।

মাদবর বাড়ির পূর্ব ভিটায় মামুনের আপন চাচা আলতাফ মাদবর ওরফে কালু মাদবরের ঘরে বসে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

কালু মাদবর জানান, তারা সাত ভাই। বাবার মৃত্যুর পর তারা একেক ভাই প্রায় দুই কানি জমি ভাগে পান। কিন্তু ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহজ সরল ছিলেন আবদুল হাই মাদবর (মামুনের বাবা)। সহজ সরল হওয়ায় অনেক দেনা ছিল তার। এক পর্যায়ে মামুনের মা মমতাজ বেগমের পরামর্শে বাড়ির জায়গাজমি সব বিক্রি করে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে শহরে চলে যান তিনি।

কালু মাদবর জানান, ছোট বেলা থেকেই ছেলেরা কেউ কোনো অপকর্ম করলে ওদের মা মমতাজ বেগম সন্তানের পক্ষ নিতেন। সন্তানদের এমন অধঃপতনের জন্য তিনি মমতাজ বেগমকেই দায়ী করেন তিনি।

কালু মাদবর বলেন, ‘মামুন মাঝেমধ্যেই গাড়ি হাঁকিয়ে এলাকায় আসতো। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলে বলতো যে এটি সার্কেল এসপির গাড়ি। এছাড়া ওই পরিবারের আর কেউ গত ত্রিশ বছরে এই বাড়িতে আসেনি।

‘যতদূর জানি বাড়ি থেকে পটুয়াখালী যাওয়ার পর মিজান আর মামুন লঞ্চে কেবিনে কাজ করত। এরপর মিজান মোটরসাইকেলের ব্যবসা আর মামুন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। কয়েক বছর আগে পত্রিকায় দেখলাম যে, মামুনের পা প্রশাসনের সঙ্গে গোলাগুলিতে কাটা পড়েছে। আর এখন শুনছি পটুয়াখালীর একজনকে অপহরণ করে ধরা খেয়েছে।’

১৯ এপ্রিল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মামুন ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। ছবি: নিউজবাংলা

তিনি আরও বলেন, ‘মিজানের অপকর্মের ঘটনাও পত্রিকায় দেখেছি। কয়েক বছর আগে পত্রিকায় খবর বের হয় যে, ঢাকার কোনো এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে অপহরণ করে দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায়ের সময় গ্রেপ্তারের পর মিজান জেলে যায়। পরে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে জেল থেকে বের হওয়ার পর আর তার দেখা নেই। কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না।’

মামুনের চাচী রাসিদা বেগম বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও ঢাকা থেকে পুলিশ আইছিল মিজানের খোঁজে। তহন মামুনেরও খোঁজ করছিল পুলিশ। ওর বোনাইর টাহা দিয়া মাতৃছায়া দোহান ফুডাইছে। হেরপর আজ শরমে মুখ দেহাইতে পারি না। হক্কুরডি খামার দেয় ডাহাইতের বংশ কইয়া। এর চেয়ে ঝোলায় ন্যালেও ভাল অইতো। ওই বেডা (মামুনের বাপ) কী সুন্দর ভাল মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। আর হের যন্নাডা কি অইলো। আর হের জন্য অই বেডার পোলা কয়ডা শ্যাষ।’

মামুনের চাচাত ভাই ওয়াসিম মাদবর বলেন, ছোটবেলায় বাড়ি ছাড়ার পর প্রায় দুই বছর আগে কয়েকবার গ্রামে এসেছে মামুন। ওই সময় অফিস বাজার এলাকার মহিউদ্দিন নামের একজনকে গাঁজা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল সে। তখন আমতলী থানার ওসির সাথে মামুনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ওই সুবাদে ওয়াসিমকেও সেই মামলায়ে জড়িয়ে দেয় মামুন।’

কারণ জানতে চাইলে ওয়াসিম বলেন, ‘মামুন এলাকার কারও ভাল চাইতো না। যেই একটু ভাল অবস্থানে থাকার চেষ্টা করতো তাকেই পুলিশ দিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করতো। কারণ পুলিশের সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল। প্রায়ই পুলিশ লেখা গাড়িতে এলাকায় এসে প্রভাব দেখাত।’

অপরাধ জগতে মামুন কিভাবে এলো- এমন প্রশ্নে ওয়াসিম মাদবর বলেন, ‘মূলত বড় ভাই মিজানই মামুনকে এই জগতে এনেছে। কারণ ওরা দুই ভেইয়ের মধ্যে খুব মিল ছিল। একে অপরকে ছাড়া কোন কাজ করতো না।’

মিজান কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অপহরণ মামলায় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে শুনেছি। তারপর মিজানের কী হয়েছে জানি না। মামুন ছাড়া এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু একটি মানুষ জীবিত থাকলে তার দেখা কেউ না কেউ তো পাবে।’

মামুনের আরেক ভাই নিজাম বর্তমানে সৌদি আরবে আছে বলেও ওয়াসিম জানান।

ওয়াসিম জানান, মামুনের পরিবার গ্রাম থেকে পটুয়াখালী শহরে এসে হেতালিয়া বাঁধঘাট এলাকার পূর্ব পাশে বায়তুল ইমান জামে মসজিদে (উকিল বাড়ির মসজিদ) বেশ কিছুদিন ইমামতি করেছেন মামুনের বাবা আবদুল হাই মাদবর। এরপর তিনি কী করতেন যোগাযোগ না থাকায় তা বলতে পারছেন না।

মামুনের অন্য চাচারাও বলতে পারেন না তার বাবা-মা বর্তমানে কোথায় আছেন। তবে কয়েক বছর আগে লোকমুখে তারা শুনেছেন যে, পটুয়াখালী শহরের গার্লস স্কুলের পশ্চিম পাশে পুলিশ সদর সাকের্লের বাসার পাশেই নাকি মামুন তার বাবা-মাকে নিয়ে থাকেন।

আত্মীয়-স্বজনরা জানান, চট্টগ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জিয়াউদ্দিন বাবলু মিয়ার সঙ্গে মামুনের ছোট বোন তানিয়া আক্তারের বিয়ে হয়। বাবলুর কাপড়ের ব্যবসা ছিল। সেই সুবাদে তানিয়ার বিয়ের পর মামুন কৌশলে ভগ্নিপতির সঙ্গে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। এক পর্যায়ে তার ভগ্নিপতির ঢাকার মাতৃছায়া বুটিকসের শাখা হিসেবে পটুয়াখালী শহরেও একটি দোকান চালু করেন মামুন ও তার বোন জামাই। তখন তারা সবাই পটুয়াখালী শহরে থাকতেন। কয়েক বছর আগে তানিয়ার স্বামী বাবলু স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে মাতৃছায়া বুটিকসের ব্যবসার হাল ধরেন মামুন।

নিজের বিলাসবহুল বাসায় কৃত্রিম পা হাতে দাঁড়িয়ে মামুন। ছবি: নিউজবাংলা

চাচাতো ভাই ওয়াসিম জানান, ভগ্নিপতির ব্যবসা থেকে মামুন মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করেন বলে শুনেছেন তারা। এরপর মামুন নিজে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে বরগুনা জেলা ও পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় আরো দুটি বড় শো-রুম খোলেন তিনি। এর মধ্যে কলাপাড়া উপজেলা সদরে মাতৃছায়ার ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে র চাচাত ভাই অলিউল্লাহ মাদবরকে।

ওই ব্যবসার আড়ালেই মূলত ইয়াবার কারবার চালাতেন মামুন। ঢাকা ডিবি পুলিশের দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও এমনটা উল্লেখ করা হয়েছে।

মামুনদের গ্রামের বাড়ি থেকে কোয়ার্টার কিলোমিটার দক্ষিণে কানাই মৃধা বাজার। ছোট্ট এই বাজার হয়েই নরমহাট থেকে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আসা-যাওয়া করে এ অঞ্চলের হাজারো মানুষ। কথা হয় ওই বাজারের একাধিক লোকের সঙ্গে। কিন্তু মামুনের প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই সবাই চুপ। এই সন্ত্রাসীর বিষয়ে কেউ কথা বলতে চাননি।

এক পর্যায়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দোকানদার বলেন, ‘হের (মামুন) হাত অনেক লম্বা। প্রায়ই এইহানে আইতো গাড়িতে করে। গাড়ির সামনে লেখা থাকতো পুলিশ। ড্রাইভারকে জিঙ্গাসা করলে বলতো- সার্কেল স্যারের গাড়ি। এত খারাপ কাম কইরাও যদি পুলিশের গাড়িতে ঘোরাফেরা করে তাইলে আমরা হের সম্পর্কে কী কমু।

‘তবে এইহানের কোনো দোকানদারের সাথে হে কখনও খারাপ আচরণ করে নাই। খাইয়া লইয়া টাহা পয়সা ঠিকঠাকভাবেই দিয়া গেছে। তাছাড়া হেরা গ্রাম ছাড়ছে ছোটবেলায়। যে কারণে অনেকের কাছেই হে অপরিচিত ছিল। আমরা লোকমুখে হুনছি- হে অনেক বড় বড় কাম করে। ওই কাম করতে গিয়াই নাকি হের নাকি পা কাটা লাগজে।’

ওই বাজারেই মামুনের এক নিকটাত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘লঞ্চে কেবিন বয়ের চাকরির পর এক সময়ে মিজান ব্যবসা শুরু করে। পটুয়াখালী শহরের চৌরাস্তা এলাকায় রংয়ের দোকান থেকে মোটরসাইকেল বেচাকেনা করতো সে। যশোর থেকে চোরাইপথে মোটরসাইকেল এনে পটুয়াখালীতে বিক্রি করত। মূলত তখনই মিজান অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময় মিজানের সঙ্গে থাকা ছোট ভাই মামুন ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপে প্রবেশ করে। তাদের দুই ভাইয়ের নামে ঢাকায় একাধিক ব্যংক ডাকাতি আর অপহরণের মামলা রয়েছে বলে শুনেছি।

এ বিভাগের আরো খবর