অনি আক্তার মিতু বিলাপ করছিলেন। বলছিলেন, ‘সরকার তো আইয়া দেখল না আমার স্বামী কোন অবস্থায় আছে? সরকার কি আইয়া দেখছে? কেউ কি আইয়া দেখছে? আমার ছেলেমেয়েদের কি দেখবে সরকারে?’
তার কোলে চার বছরের সন্তান আমির হামজা। মায়ের কান্না দেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। সাত বছরের হুমায়রা যেন মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে বাবাকে হারিয়ে।
অনি আক্তার মিতু নিউমার্কেট ও ঢাকা কলেজের ব্যবসায়ী ও ছাত্র সংঘর্ষের জেরে নিহত দোকান কর্মচারী মোহম্মদ মোরসালিনের স্ত্রী। বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা ৩৬ মিনিটে মোরসালিন মারা যান। বেলা ১টার কিছু পরে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার কামরাঙ্গীরচরের বাড়িতে।
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার কালাই গ্রামের মানিক মিয়ার সন্তান মোরসালিন।
দুদিন ধরে চলা সংঘর্ষে মোরসালিনকে নিয়ে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।
বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় কামরাঙ্গিরচরে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিম রসুলপুরের সংকীর্ণ রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাস্তায় শত শত মানুষের ভিড়। এলাকাবাসী জড়ো হয়েছেন নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের সংঘর্ষের জেরে নিহত মোরসালিনের মামার বাসায়। সেখানেই মোরসালিনের পরিবার ও সন্তানেরা আছে।
পাশেই এক জায়গায় দাফনের প্রস্তুতি হিসেবে গোসল করানো হচ্ছে মোরসালিনের মরদেহকে৷
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে মিতু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে কাজে গেছে ঘর থেকে বের হয়ে। আহত কোন সময় হইছে, আমি সঠিক জানি না। তিনটার দিকে খবর পাইছি হসপিটালে ভর্তি আছে। আমি যাইয়া দেখি, আমার স্বামীর অবস্থা ভালো না। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। মুখে অক্সিজেন। আমার স্বামীর সাথে আমাকে দেখা করতে দেয় নাই। ঢুকলেই বের কইরা দেয়। বেশি দেখতে দেয় নাই। ধরতেও দেয় নাই। রক্ত লাগব; অনেক টাকার রক্ত কিইনা দিছি। রক্ত দিয়া কাজ হয় নাই। আমার স্বামীর মাথার সব রক্ত পইরা গেছে।’
অশ্রুসিক্ত মিতু সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে বলেন, ‘আমি অসহায়। আমার স্বামী ছাড়া আমার কেউ নেই। আমার ছেলে মেয়েকে কে দেখবে? আমরা দিন আনি দিন খাই। দুনিয়ার টাকা ঋণ হইছে। মেয়ের অপারেশন করছি। ঈদের মধ্যে কইছে সব ঋণ শোধ করব। এখন কে শোধ করবো ঋণ? সরকারের কাছে এতটুকু হেল্প চাই। আমার ছেলে-মেয়েকে দেখুক। আমাকে দেখুক। এতটুকুই হেল্প চাই।’
মোরসালিনের ভাইয়ের স্ত্রী লুনা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওরে আমি ছোট থেকে পালছি। আমার সন্তানের চেয়েও বেশি আদর করি। আজকে তিন দিন ধইরা মার্কেটে হামলা। আমার ভাইরে আপনারা ফেরত দিতে পারবেন? ঢাকা কলেজের ছেলেরাও ফেরত দিতে পারত না। মার্কেট কেন বন্ধ দিলো না?’
মোরসালিনের মা নুরজাহান বেগমের বিলাপ যেন থামছে না। থেমেই থেমেই কাঁদছেন তিনি। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি বিচার চাই। দুইটা ছোট ছোট শিশু থুইয়া আমার পুতে গেছে গা। আমার পুতের যেন বিচার পাই। আমার নাতি দুইডার যেন একটা ব্যবস্থা কইরা দেয়।’
মোরসালিনের শ্যালক ফরহাদ হোসেন মুন্না তার সাথে একই দোকানে কাজ করেন। তিনি মঙ্গলবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দুইজন একসাথে বাসা থেইকা বাইর হইছি। মার্কেটে ঢুইকা দেখি দোকানপাট বন্ধ। দোকান খুইলা দেখি কাস্টমার নাই। কারেন্টের লাইন বন্ধ কইরা দিছে। বসেরে ফোন দিছি। কইলো দোকান বন্ধ কইরা বাসায় চইলা যাও। ১টা বাজে দোকান বন্ধ কইরা আমি একটা ধাওয়ানি খাইছি। ভাই নামাজ পড়তে গেছে। ফোনে শুনলাম দুলাভাই হাসপাতালে ভর্তি। পরে আমি বাসায় আইসা আপারে নিয়া গেছি। ফ্যামিলির আয়ের লোক খালি দুলাভাই ছিল।’
মোরসালিনের মামাতো ভাই জাহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেদিন গ্যানজাম, হয় সেদিন ও নামাজ পড়তে বাইর হইছিল। সারাদিন রোজা ছিল। নামাজ পড়তে গিয়াই ইটের হামলার শিকার হয়। তিন দিন থাকার পরে সে ভোরে মারা গেছে।’