২৫ মার্চ কালরাত স্মরণে পাঁচ বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসলেও দিবসটিকে উপেক্ষা করে আসছে বিএনপি। বরাবরের মতো বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের দিবস ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসও পালন করেনি দলটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় এই দুটি দিন কেন দলটি উপেক্ষা করছে- এ নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা বারবার প্রশ্ন করে আসছেন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে এই আক্রমণের কোনো জবাবও দেয়া হয় না।
স্বাধীনতা সংগ্রামের এমন একটি অবিস্মরণীয় দিন নিয়ে কেন নিশ্চুপ ভূমিকায় থাকে দলটি?
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু জবাব দিলেন ‘মুজিবনগর দিবস অস্থায়ী সরকার গঠনের দিন। এটা একটি সরকারি দিবস। সরকারিভাবে তো পালন হচ্ছে। সরকারিভাবে পালন করলে সেটা সবার পালন হয়ে যায়। আলাদা করে কেউ করল কি করল না তাতে যায় আসে না। এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।’
‘আর বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। এটা নিঃসন্দেহ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এটার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে।’
তিনি বলেন, ‘আবার ধরেন ওসমানীর জন্মবার্ষিকী, শহীদ জিয়ার জন্মবার্ষিকী এগুলো তো সরকারি দিবস না। এগুলো যার যার অনুসারীরা, সংগঠনগুলো পালন করে। আর মুজিবনগর দিবস একটি সরকারি দিবস। সরকার পালন করছে মানে সবাই পালন করছে।’
এই যুক্তিতে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসও তো বিএনপির পালন করার দরকার নেই। কারণ সরকারিভাবে পালিত হলে তো সবার পালন হয়ে যায়।
এমন প্রশ্ন করলে দুদু কোনো জবাব দেননি। তিনি বলেন, ‘আমার যা বলার, আমি বলেছি। ধন্যবাদ।’
একই প্রশ্নে দলটির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি আমতা আমতা করে বলেন, ‘এটা নিয়ে…আসলে…আপনি বরং মহাসচিবকে একটা ফোন দেন। তিনি এটার উত্তর দেবেন।‘
তবে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য নিউজবাংলা পায়নি। একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
পরে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এই প্রশ্নে বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি ভালো না। এই অবস্থায় এখন সংকট কাটিয়ে ওঠা নিয়ে ভাবা জরুরি। ১৭ এপ্রিল গুরুত্বপূর্ণ দিন। এমন আরও দিন আছে। সব পালন সম্ভব না।’
১৯৭১ সালের গণহত্যার স্মরণে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে পাঁচ বছর ধরে। কিন্তু বিএনপি এই দিনে কোনো কর্মসূচি রাখে না
তিনিও বিষয়টি নিয়ে মির্জা ফখরুলকে কল করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এগুলো দলীয় সিদ্ধান্ত। কারও একার না।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের পর। সেই রাতেই রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয় অগুণতি মানুষকে, পরের নয় মাস চালু থাকে সেই গণহত্যা।
২০১৭ সালে এই দিনটি সরকার জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। রাত ৯টার দিকে এক মিনিট আলো বন্ধ রেখে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পাশাপাশি আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রধান দলগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম বিএনপি।
সরকার এই দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের চেষ্টাও করছে। আন্তর্জাতিকভাবে ৯ ডিসেম্বর দিবসটি পালিত হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্তে। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো গণহত্যাবিষয়ক প্রথাটির ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং গণহত্যায় মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ ও সম্মান করা। এটি জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে এ-ও স্মরণ করিয়ে দেয় যে তাদের নিজ জনগণকে গণহত্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দায়িত্ব আছে।
বাংলাদেশ মনে করে, ২৫ মার্চ বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট গণহত্যার একটি শুরু হয়েছে। ফলে এটিই হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস।
অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ নেয় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে এই সরকারের শপথ হয় বলে দিনটি মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালিত হয়।
সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে বিভিন্ন মন্ত্রিসভায় রেখে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও অনুমোদিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য করা হয়। এই সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে।
এই দিবসটি উপেক্ষা করায় ১৭ এপ্রিল বিএনপিকে আক্রমণ করেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি সেদিন এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান প্রবাসী সরকারের কাছ থেকে মাসে ৪০০ টাকা ভাতা পেতেন। আজকে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি মুজিবনগর দিবস পালন করে না।
‘তারা যে মুজিবনগর দিবস পালন করে না, এটি প্রকারান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্বীকার করা, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে অস্বীকার করার শামিল।’
হাছান মাহমুদ বিএনপিকে নিয়ে কোনো বক্তব্য দিলে সচরাচর পরের দিনই তার পাল্টা জবাব আসে দলটির পক্ষ থেকে। তবে তার এই বক্তব্যের কোনো জবাব দেননি বিএনপি নেতারা।