রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে গুরুতর আহত নাহিদ মিয়া পরে হাসপাতালে মারা যান। এলিফ্যান্ট রোডের একটি কম্পিউটার বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান ছিলেন নাহিদ।
নাহিদের মৃত্যু ঘিরে বিভিন্ন তথ্য ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দাবি করা হচ্ছে ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে প্রাণ হারান তিনি। পরিবারও দাবি করছে, বাসা থেকে দোকানে যাওয়ার সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন নাহিদ।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, নাহিদও ওই সংঘর্ষে যোগ দিয়েছিলেন। তার অবস্থান ছিল নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের পক্ষে। একপর্যায়ে বিপরীত দিকে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা একদল হেলমেটধারী তরুণ নাহিদকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন।
ঢাকা কলেজের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশের নুরজাহান মার্কেটের সামনে মারধরের শিকার হন নাহিদ। সে সময়ের ভিডিও ফুটেজ এবং এর কিছু আগে ব্যবসায়ীদের পক্ষে নাহিদের সংঘর্ষে জড়ানোর বেশ কিছু আলোকচিত্র পেয়েছে নিউজবাংলা। এসব ছবিতে নাহিদের উপস্থিতি তার প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষও শনাক্ত করেছে।
নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় ব্যবসায়ীদের পক্ষে নাহিদের অবস্থান
রাস্তার পাশে পিটুনির শিকার নাহিদকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। পরে রাত সোয়া ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে নাহিদের মাথায় চারটি আঘাতের চিহ্নের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া দেহের বিভিন্ন অংশে জখমের উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুযায়ী, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নুরজাহান মার্কেটের সামনে অবস্থান ছিল ঢাকা কলেজ ছাত্রদের। আর ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনে ছিলেন ব্যবসায়ীরা। দুই পক্ষই একে অপরের দিকে ইটপাটকেল ছুড়ছিল। চলছিল ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
একপর্যায়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের ধাওয়ার মুখে ব্যবসায়ীরা পিছু হটে গাউছিয়া ও নিউ মার্কেটকে সংযুক্ত করা ওভার ব্রিজের নিচে চলে যান। আরেক অংশ চলে যায় ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের দিকে।
নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় ব্যবসায়ীদের পক্ষে নাহিদের অবস্থান
পরে ব্যবসায়ীরা সংগঠিত হয়ে ধাওয়া দিলে ছাত্ররা নূরজাহান মার্কেটের সামনে থেকে সরে বদরুদ্দোজা মার্কেট ও গ্লোব মার্কেটের দিকে চলে যান।
সংঘর্ষের সময়ের বিভিন্ন ছবিতে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার পর থেকে ঘটনাস্থলে নাহিদকে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষে তাকে সংঘর্ষে অংশ নিতে দেখা যায়। তার পরনে ছিল ডি-লিংকের মনোগ্রাম সংবলিত টি-শার্ট। তিনি কখনও ছাত্রদের দিকে ইট ছুড়ছেন, কখনও বড় ছাতার আশ্রয় নিয়ে ছাত্রদের ছোড়া ইট থেকে নিজেকে রক্ষা করছিলেন।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নিউজবাংলাকে জানান, বেলা ১টার দিকে ব্যবসায়ীরা ছাত্রদের ধাওয়ার মুখে কিছুটা পিছু হটলে নুরজাহান মার্কেটের সামনে আটকে পড়েন নাহিদ। সকাল থেকেই ঢাকা কলেজের ছাত্রদের পক্ষে সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী হেলমেটধারীরা এ সময় তাকে বেদম মারধর করেন। আঘাতে ফুটপাতে লুটিয়ে পড়েন নাহিদ।
নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় ব্যবসায়ীদের পক্ষে নাহিদের অবস্থান
নিউজবাংলার হাতে আসা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, নুরজাহান মার্কেটের সামনে ফুটপাতে পড়ে আছেন নাহিদ। কালো হেলমেট পরা একজন তাকে আঘাত করছেন। পরে হলুদ হেলমেট পরা একজন কালো হেলমেটধারীকে সরিয়ে নেন।
ভিডিওতে যাকে দেশীয় অস্ত্র হাতে নাহিদকে পেটাতে দেখা গেছে, তিনি সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিলেন।
গুরুতর আহত নাহিদকে এক পর্যায়ে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
নাহিদ অফিস না গিয়ে যোগ দেন সংঘর্ষে
সংঘর্ষে নিহত নাহিদ মিয়ার বাসা কামরাঙ্গীরচরের মধ্য রসুলপুর এলাকায়। তার কর্মস্থল এলিফেন্ট রোডের মাসুমা প্লাজার দ্বিতীয় তলায়। প্রতিষ্ঠানের নাম ডেটাটেক। কম্পিউটার বিক্রির এই প্রতিষ্ঠানে ডেলিভারি ম্যানের কাজ করতেন নাহিদ।
প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে ডেটাটেক দোকানটি খোলা হয়। নাহিদও সাধারণত এ সময়ের মধ্যে অফিসে আসতেন।
ঘটনার দিন সকাল ১০টার দিকে ডেটাটেকের ইনচার্জ রেজাউল করিমকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে নাহিদ জানান, তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। দোকানে পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক লাগবে।
নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় ব্যবসায়ীদের পক্ষে নাহিদের অবস্থান
রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে জানান, বেলা সাড়ে ১২টা বেজে গেলেও নাহিদ অফিসে না আসায় অপরিচিত ওই নম্বর তিনি ফোন দেন। তখন নাহিদ জানান, নিউ মার্কেটে ঝামেলা হচ্ছে, যে কারণে তিনি আসতে পারছে না। তখন রেজাউল অন্য দিকের রাস্তা ঘুরে নাহিদকে দোকানে আসতে বলে।
ডেটাটেকে জাহাঙ্গীর নামে আরও একজন ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করেন। তার বাসাও কামরাঙ্গীরচরে।
জাহাঙ্গীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দুজন সাধারণত কামরাঙ্গীরচর থেকে নবাবগঞ্জ হয়ে নিউ পল্টন, ওখান থেকে রাইফেল স্কয়ার ৩ নম্বর গেট বা নিউ সুপার মার্কেটের ভেতর দিয়ে ঢুকি। আর নিউ সুপার বন্ধ থাকলে নীলক্ষেত মোড় হয়ে নিউ মার্কেটের ১ নম্বর গেটের সামনে দিয়ে গাউছিয়া, ইস্টার্ন মল্লিকা হয়ে এলিফেন্ট রোডের দোকানে আসি।’
তবে মঙ্গলবার জাহাঙ্গীর ও নাহিদ একসঙ্গে দোকানের উদ্দেশে রওনা হননি। জাহাঙ্গীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ঘটনার দিন ওই পথ ধরেই আসছি। ও হয়তো গাউছিয়ার সামনে এসে মারামারি দেখে ওদের (ব্যবসায়ী) সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।’
হামলায় আহত নাহিদকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিচ্ছেন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা
নিউজবাংলার হাতে আসা সংঘর্ষের সময়ের ছবিগুলো দেখে নাহিদকে শনাক্ত করেছেন তার সহকর্মীরা।
ডেটাটেকের বিলিং ইনভেনটরি শাখায় কর্মরত শামীম আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছবিতে যে টি-শার্টটি দেখা যাচ্ছে, তা রাউটার কোম্পানি ডি-লিংকের। ওই টি-শার্ট আমরাই ওকে দিয়েছিলাম।’
নাহিদের খালা মনিকা আক্তারও ছবিতে নাহিদকে শনাক্ত করেছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই টি-শার্ট পরেই নাহিদ সকালে বাসা থেকে বের হয়। ওর অফিসে যাওযার কথা ছিল। যাওয়ার পথে মারামারি মধ্যে পড়ছিল। কারা মারছে আমরা জানি না।’
নাহিদের সুরতহাল প্রতিবেদন
দায়ীদের শনাক্তে ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ চলছে
নাহিদ হত্যার ঘটনায় তার চাচা মো. সাইদ নিউ মার্কেট থানায় বুধবার হত্যা মামলা করেন। এতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে। ঘটনাস্থল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে নুরজাহান মার্কেটের প্রীতিমনি ফ্যাশন নামের দোকানের সামনের রাস্তা।
মামলার তদন্তকারীরা জানান, তারা ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সংগ্রহ করছেন। সেগুলো বিশ্লেষণ করে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ডিএমপি নিউ মার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নাহিদ হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। আমরা তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করছি। ছবি, ভিডিও বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।’