পটুয়াখালীর বড় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার শিবু লাল দাসকে অপহরণ করার মূলহোতা ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। এক সময় রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের সহযোগী ছিলেন তিনি। বুধবার ইফতারের আগে এক সংবাদ সম্মেলনে মামুনসহ আরও তিনজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে গুলশান ডিবি পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৯ এপ্রিল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিরপুর, ভাটারা এবং গুলিস্তানে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে ল্যাংড়া মামুন, পিচ্চি রানা, জসিমউদ্দিন এবং আশিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে বিআরটিসির অপর চালক জসিম মৃধাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
গ্রেপ্তারের সময় আসামিদের কাছ থেকে অপহরণে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার, মোবাইল ফোন, গামছাসহ ৪ হাজার পিস ইয়াবাও উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার আসামিদের বরাতে পুলিশ জানায়, ব্যবসায়ী শিবু লাল দাসকে অপহরণের পরিকল্পনা করা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের কাছাকাছি ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টস অফিসে সেই পরিকল্পনায় মামুন ছাড়াও অংশ নেন পিচ্চি রানা, পাভেল ও বিআরটিসির ড্রাইভার জসিম।
এ নিয়ে পরে আরও বেশ কয়েকটি মিটিং হয়। মিটিংয়ে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে যোগ দেন জসিম উদ্দিন মৃধা এবং তার ভাই গাড়ির দালাল আশিক মৃধা।
অপহরণের কাজে ব্যবহারের জন্য ১০ হাজার টাকা অ্যাডভান্স করে ঢাকা থেকে এক সপ্তাহের জন্য একটি গাড়িও ভাড়া করা হয়। এ ছাড়া অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ঢাকার সাভার থেকে কেনা হয় পাঁচটি বাটন ফোন। আর বেশি দাম দিয়ে অন্যজনের নামে নিবন্ধন করা সিম কেনা হয় পটুয়াখালী থেকেই। সংগ্রহ করা হয় একটি খেলনা পিস্তল, দুইটি সুইচ গিয়ার, তিনটি চাপাতি এবং গরু জবাই করার একটি বড় ছুরিও।
টানা কয়েকদিন ব্যবসায়ী শিবুকে অনুসরণ ও তার বিভিন্ন অবস্থান রেকি করে ফিল্মি স্টাইলে তাকে অপহরণ করা হয় ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটায়।
সেদিন দুপুরে পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের কাছে মিলিত হন অপহরণকারীরা। কার কোথায় কি দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেন ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। পরে শিবুর গতিবিধি মোবাইলে জানানোর জন্য পিচ্চি রানা তার মোটরসাইকেলে ল্যাংড়া মামুনকে নিয়ে চলে যান গলাচিপা ঘাটে।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়ার জন্য পটুয়াখালী-গলাচিপা হাইওয়ে রোডের শাঁখারিয়া এলাকার নির্জন স্থানে একটি প্রাইভেটকার এবং একটি ট্রাক্টর নিয়ে অবস্থান নেন ৫ জন।
ল্যাংড়া মামুনের নির্দেশে আগে থেকেই ট্রাক্টর ভাড়া করে রেখেছিলেন ড্রাইভার বিল্লাল। এ ছাড়া ভাড়া করা প্রাইভেটকারটি নিয়ে ড্রাইভার আশিক মৃধা, পাভেল, হাবিব, ও সোহাগ অবস্থান করছিলেন।
ল্যাংড়া মামুনের সংকেত পাওয়ার পরই রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিল্লাল ট্রাক্টরটি নিয়ে সুকৌশলে শিবু দাসের প্রাডো জিপের সামনে আড়াআড়ি করে অবস্থান নেন। আর জিপের পেছনেই ভাড়া করা প্রাইভেটকারটি দাঁড় করিয়ে অবরুদ্ধ করে ফেলেন আশিক।
এ সময় ট্রাক্টর এবং প্রাইভেটকার থেকে অপহরণকারীরা খুব দ্রুততার সঙ্গে উঠে যান শিবুর প্রাডো জিপে। আশিক শিবুর গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেন। গাড়িতে উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ ভিকটিমদের বেঁধে ফেলেন। এ সময় গামছা, টিস্যু পেপার এবং স্কচ টেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চলতে থাকে চড়-থাপ্পড় আর কিল ঘুষি। সঙ্গে থাকা খেলনা পিস্তল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিবুকে ভয়ও দেখানো হয়।
এভাবে বরগুনার আমতলী এলাকার গাজিপুরায় গিয়ে জিপ থেকে শিবু ও তার চালককে নিয়ে তোলা হয় ভাড়া করে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া প্রাইভেটকারটিতে। সেখানে ভিকটিম দুইজনকে আরও ভালোভাবে বেঁধে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢুকানো হয়। এই সময়ের মধ্যেই শিবুর জিপটি আমতলীর একটি ফিলিং স্টেশনে ফেলে আসেন অপহরণকারীরা।
রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটার দিকে পটুয়াখালীর বাঁধঘাট এলাকায় ভিকটিমদের বহনকারী গাড়ি বুঝে নেন ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। এ সময় গাড়ি চালাতে থাকেন ল্যাংড়া মামুন নিজেই। তিনি সোজা চলে যান এইচ ডি রোডে থাকা তার নিজস্ব মেশিনঘর কাম টর্চার সেলে। সেখান থেকে পরে অপহৃতদের নিয়ে যাওয়া হয় এসপি কমপ্লেক্স সুপার মার্কেট আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্থায়ী সেলে। সেখানে রাতভর চলে নির্যাতন।
রাত পৌনে ২টার দিকে রানার নির্দেশে ভিকটিম শিবুর সিম থেকে তার স্ত্রীকে ফোন দেন বিল্লাল। ফোনে শিবুর স্ত্রীকে পরদিন দুপুর ২টার দিকে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিতে বলা হয়। টাকা না দিলে কিংবা বিষয়টি পুলিশকে জানালে শিবু লালকে হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হবে বলেও সতর্ক করে দেন অপহরণকারীরা।
এদিকে পরদিন ১২ এপ্রিল রাত ১১টায় অপহরণের ২৬ ঘণ্টা পর হাত-পা ও মুখ বাঁধা এবং বস্তাবন্দি অবস্থায় মুমূর্ষ শিবু ও তার চালককে এসপি কমপ্লেক্স শপিং সেন্টারের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে উদ্ধার করে পটুয়াখালী জেলা পুলিশ। উদ্ধারের পরই চিকিৎসার জন্য তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
পুলিশের বরাতে জানা গেছে, এই অপহরণের নেপথ্যে ছিল গ্রেপ্তার হওয়া ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপনের স্বপ্ন। মুক্তিপণের টাকায় তিনি দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দিতে চেয়েছিলেন।
ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুন পঙ্গু। অতীতে অপরাধ করতে গিয়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার ডান পা উরু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়। বাবা মুফতি মাওলানা হওয়ায় মামুনও হাফেজী এবং নূরানী লাইনে দীর্ঘ পড়াশোনা করেন। পরে জড়িয়ে পড়েন অপরাধ জগতে।
এক সময় আপন ভগ্নিপতির বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে পটুয়াখালী জেলা শহরে একাধিক দোকান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হন মামুন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীসহ ও বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিজের দুটি টর্চার সেলে আটকে রেখে আপত্তিকর ছবি তুলে তাদের কাছ থেকে প্রায় সময়ই টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি।
অপর আসামি পিচ্চি রানা বিভিন্ন টোলপ্লাজায় টোল কালেকশনের কাজ করেছেন। ট্রাকের মিডিয়াম্যান হিসেবেও তার কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তৃণমূলের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় তিনিও ভেবেছিলেন অপহরণ করে বড় অঙ্কের টাকা পেলে তা দিয়ে একাধিক ট্রাক কিনে ঢাকা- পটুয়াখালী রুটে পরিবহন ব্যবসা করবেন।
এ ছাড়া বিআরটিসির চালক জসিম উদ্দিন মৃধা ভেবেছিলেন, অপরের গাড়ি না চালিয়ে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে নিজেই বাস কিনে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে পটুয়াখালী রুটে চালাবেন।
গ্রেপ্তার আশিক দীর্ঘদিন ধরে রেন্ট-এ-কারের দালালি করেন। তিনিও ভেবেছিলেন নিজের ভাগের অর্থ দিয়ে একাধিক গাড়ি কিনে বড় পরিসরে রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা শুরু করবেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে মারামারি, মাদক এবং অপহরণের একাধিক মামলা রয়েছে। মাওলানা হিসেবে পিতার সুখ্যাতি এবং নিজের পঙ্গুত্বের দোহাই দিয়ে অনেক অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করলেও ল্যাংড়া মামুন একজন দুর্ধর্ষ ক্যাডার। অপহরণ বাণিজ্য চালানোর জন্য পটুয়াখালীতে গড়ে তুলেছিলেন দুটি টর্চার সেল। মাদকসেবনের পাশাপাশি মাদক ব্যবসার সঙ্গেও তিনি জড়িত। নিজের কৃত্রিম পায়ের ভেতরে করে অনায়াসে হাজার হাজার পিস ইয়াবা বহন করতে পারতেন তিনি।
আসামীদের অপরাধের ইতিহাস সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে পুলিশ।