চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে রেলসেতু থেকে নারীর বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মরদেহ উদ্ধারের পরদিন বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। রেলসেতুতে ঝুলন্ত অবস্থায় ওই নারীর ছবি শেয়ার করে অনেকেই দাবি করেন, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয় সেতুতে। তবে এখন পর্যন্ত হত্যা ও ধর্ষণের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পায়নি পুলিশ।
মিরসরাইয়ের হিঙ্গুলি ইউনিয়নের আজম নগর এলাকার চট্টগ্রামমুখী রেলসেতু থেকে পুলিশ ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে গত শুক্রবার সন্ধ্যায়। ওই দিন ঠিক কী ঘটেছিল জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা।
মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত ধুমঘাট রেলসেতু। মহাসড়কের ওপর নির্মিত ব্রিজ থেকে ধুমঘাট রেলসেতুর দূরত্ব ২০০ গজের মতো। তবে সড়কপথে দূরত্ব দ্বিগুণেরও বেশি।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ফেনী নদীর আগে ধুমঘাট বাজার। এই বাজার থেকে একটি কাঁচা রাস্তা পূর্ব-উত্তর দিক হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে রেললাইনের সমান্তরালে রেলসেতুর নিচ দিয়ে ফের চলে গেছে পূর্ব-উত্তর দিকে।
শুক্রবার ফেনী নদীর তীরে এই সড়কের পাশেই রেলসেতুতে ঝুলে ছিলেন ওই নারী।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, ওই এলাকায় পাশাপাশি দুটি রেলসেতু। একটি ঢাকামুখী এবং অন্যটি চট্টগ্রামমুখী। রেলসেতুর দুপাশেই বালুমহাল, নদীতে বালু উত্তোলনে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। এর মধ্যে সেতুর উত্তর-পূর্ব পাশের বালুমহালের শ্রমিকরা ঘটনার দিন এস্কাভেটর নষ্ট থাকায় কাজে ছিলেন না।
বিপরীত পাশে কাজ করা শ্রমিকদের কয়েকজন কাজে ছিলেন সেদিন। তাদের মধ্যে ইকবাল হোসেন নামের একজন বলেন, ‘শুক্রবার জুমার নামাজ থেকে আসার পর একটা মহিলাকে সেতুতে ঝুলে থাকতে দেখেছিলাম। আমরা মনে করেছি হয়তো রেলে কাটা পড়েছে। তবে তাকে আমরা কেউ চিনতে পারিনি। আর আমাদের চেনার কথাও না, কারণ আমরা এখানে কাজ করি মাত্র, কেউ এই এলাকার না।’
ওইদিন রাতে পুলিশ মরদেহটি ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
সে রেলসেতুর নিচে বালুমহালের শ্রমিকদের বিশ্রামের ছোট ছোট তিনটি খুপরি ঘর রয়েছে। সেসব ঘরের দুটি বন্ধ থাকলেও একটিতে পাওয়া যায় আবুল হোসেন ও নুরুল আলম নামের দুজন শ্রমিককে।
নুরুল আলম বলেন, ‘ঘটনার দিন আমরা ছিলাম না, আমাদের এস্কাভেটর নষ্ট ছিল। তবে ঘটনা শুনেছি। রেলসেতুর দুপাশে শ্রমিকরা কাজ করলেও সেতুটি নির্জন, মানুষজন কাজ ছাড়া খুব একটা আসে না। কিছু কিছু মানুষ রাস্তা দিয়ে ঘুরে না এসে রেলসেতু দিয়ে পার হয়ে যায়। সেই সংখ্যাটা অবশ্য খুব কম। সারা দিনে দশজন মানুষও পার হয় না।’
তিনি বলেন, ‘ওই মহিলার রেলে কাটা পড়ার আশঙ্কা নেই, কারণ রেল যাওয়ার সময়ও ওই মহিলা সেতুতে মূল রেললাইনের পাশের পাতে নির্বিঘ্নে দাঁড়াতে পারত। পাশে যথেষ্ট জায়গা আছে। তা ছাড়া কিশোরগঞ্জ থেকে এই এলাকায় আসবেই বা কেন? হয়তো কেউ মেরে রেল থেকে ফেলে দিয়েছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আলতাফ হোসেনও একই কথা বলেন নিউজবাংলাকে। তিনি বলেন, ‘রেললাইন পার হওয়ার সময় যদি রেলে কাটা পড়ত তাহলে শরীরের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। তা ছাড়া কিশোরগঞ্জ থেকে ওই মহিলা এখানে এসে রেলসেতু পার হতেই বা যাবেন কেন?
‘তবে শুক্রবার হওয়ায় জুম্মা ছিল। শ্রমিকরা বলতেছে, জুমার পর থেকে দেখছে মরদেহটা, তাহলে জুমার সময় কেউ এসে রেখে গেল কি না সেটাও একটা প্রশ্ন হতে পারে। তবে আমার মনে হয় কেউ রেল থেকে ফেলে দিয়েছে।’
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রেলসেতুর নিচ দিয়ে যে সড়কটা পূর্ব-উত্তর দিকে গেছে, ওই সড়ক থেকে রেলসেতু ৭ থেকে সাড়ে ৭ ফিট ওপরে। অর্থাৎ স্বাভাবিক উচ্চতার কোনো মানুষ সহজে নিচ থেকে কাউকে মৃত বা জীবিত অবস্থায় সেতুর পাতে রাখতে পারবে না।
তবে সেতুর যে পাতে ওই নারীর মরদেহ ঝুলে ছিল, সেটা রেললাইনের বাইরে। ট্রেন থেকে কেউ পড়ে গেলে বা ট্রেনের ধাক্কা খেলে ওই পাতে পড়তে পারেন।
ঘটনাটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লেও এলাকায় খুব বেশি জানাজানি হয়নি। ঘটনাস্থলের আশপাশের একাধিক ব্যক্তি ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এমনকি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সোনা মিয়া ঘটনার দুদিন পর নিউজবাংলার প্রতিবেদকের কাছেই প্রথম শোনেন ঘটনাটি।
ঘটনার পরদিন ফেসবুকে দেখে জানতে পারেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আলতাফ হোসেন।
ঘটনার চার দিন পেরিয়ে গেলেও ওই নারীর স্বজনদের দেখা পায়নি পুলিশ। তবে মোবাইলে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার সীতাকুন্ড ফাঁড়ির ইনচার্জ খোরশেদ আলমের সঙ্গে নিহতের বড় ভাই মাইন উদ্দিনের একাধিকবার কথা হয়েছে বলে জানা গেছে।
মাইন উদ্দিনের বরাতে খোরশেদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিহত নারীর নাম রাজিয়া খাতুন। তিনি গত ১৮-১৯ বছর পর্যন্ত মানসিকভাবে অসুস্থ। তার স্বজনরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ায় তার চিকিৎসা করাতে পারেননি। তারা এতটাই অসচ্ছল যে গাড়িভাড়ার কারণে চট্টগ্রাম আসতে পারতেছেন না। মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় রাজিয়া আড়াই বছর আগে স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর পরিবারের কেউ তার কোনো খোঁজ পায়নি।’
এর আগে রোববার তিনি নিউজবাংলাকে বলেছিলেন, ‘শুক্রবার আমরা ইফতারের পর মরদেহটি উদ্ধার করি। মরদেহের শরীরে বেশ কিছু আঘাত ছিল। হাত-পা ভাঙা ও মাথায়ও ভারী জখম ছিল। তা ছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রেলে কাটার মতো দাগও ছিল। সাধারণত রেলের ধাক্কায় মারা গেলে মরদেহের অবস্থা এমন হয়ে থাকে।
‘তাই আমাদের ধারণা, তিনি ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছেন৷ এ রকম কোনো মরদেহ পাওয়া গেলে সব সময় সঙ্গে নারী সদস্যদের (পুলিশি) নিয়ে যাই। তারা পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে কোনো সমস্যা পাননি। শুরুতে তার পরিচয় পাইনি। পরে পিবিআইয়ের সহযোগিতায় রোববার বিকেলে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত হয়েছি।’
পুলিশ ওই নারীর মরদেহের ময়নাতদন্ত ছাড়াও ভ্যাজাইনাল সোয়াব সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠায়। তাই আপতত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না বলেও জানান খোরশেদ আলম।
নিহত রাজিয়ার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে নিউজবাংলা একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।