মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম কাজী মোহাম্মদ আলীর। ছয় ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনিই বড়। অভাবের সংসারের হাল ধরতে বিএসসি পরীক্ষা দিয়েই শুরু করেন চাকরি। তখন থেকেই লক্ষ্য ঠিক করেন গরিব মানুষের জন্য কিছু করবেন।
১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করেন মোহাম্মদ আলী। যা আয় করতেন সেখান থেকে অল্প করে টিনের কৌটায় টাকা জমানো শুরু করেন। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করেন টাকা জমানো। ২০০৫ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি।
৪০ বছর ধরে তার সেই সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ লাখ টাকা। সঞ্চয়ের সেই টাকা নিজের বা পরিবারের জন্য না রেখে পুরোটাই দান করেছেন শিশুদের ক্যানসারের চিকিৎসায়।
মোহাম্মদ আলী চট্টগ্রামের হামজারবাগ এলাকার বাসিন্দা। তার বয়স এখন ৮০ বছর।
কাজী মোহাম্মদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার দাদা, বাবা সবাই শিক্ষিত। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। বাবাকে দেখতাম কষ্ট করে ৯ ভাইবোনের সংসার চালচ্ছিলেন। সেই সংসারের বড় ছেলে হিসেবে বিএসসি পরীক্ষা শেষ করে পাস করার আগেই একটা বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির (ফাইজার পরে সেটা রেনেটা হয়) বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি শুরু করি। সেটা ছিল ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বর মাস।
‘আমার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আমি গরিবদের কষ্ট, দুর্দশা নিজের চোখে দেখেছি। তখন থেকেই মনে মনে চিন্তা করতে থাকি এইসব দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করতে পারি কি না।’
কীভাবে শুরু
কাজী মোহাম্মদ আলী জানান, ১৯৮০ সাল থেকে টাকা জমানো শুরু। বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করার কারণে নিজের বেতনের বাইরেও উপার্জনের সুযোগ ছিল। বেতন দিয়ে সংসার চালাতেন। বেতনের বাইরের উপার্জন থেকে টাকা জমাতেন।
তিনি বলেন, ‘বেতনের বাইরে ইনসেনটিভ, যাতায়াত খরচ, এচিভমেন্ট বোনাস, কনভেন্স যেগুলো পেতাম, সেগুলো আলাদা রাখতাম। সেখান থেকে আমি কিছু খরচ করতাম। কিছু টাকা আলাদা করে কৌটায় জমা করতাম কিন্তু সেটা গোপনে। জানিয়ে করলে হয়তো শুনতে হতো এটা চাই, ওটা চাই। টিনের কৌটা, আইসক্রিমের কৌটায় রাখলে সেটা গোপন থাকত।’
কাজী মোহাম্মদ আলীর ভাবনায় আসে অল্প অল্প দেয়ার চেয়ে বড় একটা অঙ্কের টাকা জমিয়ে যদি কোথাও দেয়া যায় সেটা কাজে লাগবে। সেই চিন্তা থেকে লক্ষ্য স্থির করেন টাকা সঞ্চয় করে পরিমাণ বড় করার। টার্গেট করেন ৫০ লাখ টাকা জমানোর।
কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘টাকার অঙ্ক বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে। ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করলাম। বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা রাখতাম। এর বাইরে অনেককে টাকা ধার দিতাম, ব্যাংকে যে ইন্টারেস্ট দেয় সেই শর্তে। তারা সহজে ঋণ নিয়ে সেটা আমায় ফেরত দিত। এইসব কিছু গরিবদের জন্য সেই ফান্ডে জমা করতাম। এভাবে করতে করতে টাকার অঙ্কটা বাড়তে থাকে।
‘সর্বশেষ ৫০ লাখ টাকা জমানোর পর আমি চিন্তা করি এই টাকা আমি রোগীদের পেছনের ব্যয় করব। সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমি একটা আনকমন জায়গা বেছে নিলাম। সেটা হলো ক্যানসার চিকিৎসার জন্য। আরও স্পেসিফিকভাবে বললে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যয় করব।’
শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসায় দান যে কারণে
কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘১৮ বছরের নিচে যে শিশুরা আছে, তাদের চিকিৎসায় এই টাকা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। বড়দের ক্যানসার হলে সেটার চিকিৎসা করালেও বেশি দিন বাঁচে না দেখেছি। তবে শিশুদের ক্যানসার নিরাময়যোগ্য ও সাকসেস রেট খুব বেশি শুনেছি। বাচ্চাদের ক্যানসার হলে যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পায় তাহলে তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।’
ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যয়ের পেছনে আরও কারণ জানান তিনি। বলেন, ‘আমার নানা ক্যানসারে মারা গেছেন, আমি নিজে চিকিৎসা করিয়েছি। আমার মা ক্যানসারে মারা গেছেন। আমার ছোট বোনের মেয়েও ক্যানসারে মারা গেছে। আমার পরিবারের তিনজনকে ক্যানসারের কারণে হারিয়েছি, এটা আমাকে এই চিকিৎসায় ব্যয় করতে আরও অনুপ্রাণিত করেছে।
‘যখন শুরু করি তখন শুধু গরিবদের জন্য কিছু করব এ রকম লক্ষ্য নিয়ে টাকা জমানো শুরু করি। শেষে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যয়ের জন্য সিদ্ধান্ত স্থির করি।’
সম্প্রতি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে একটি ওয়াক্ফ হিসাব খুলে মোহাম্মদ আলী টাকাটা জমা দেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির নামে। সেই টাকার এক বছরের মুনাফা প্রতি বছর ব্যয় হবে শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসায়।
কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এই টাকাটা কেউ তুলতে পারবে না। এই টাকা থেকে প্রাপ্ত মুনাফা শিশুদের ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যয় হবে। যতদিন ব্যাংক থাকবে ততদিন এই টাকা থাকবে।’
বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে পরিবার
টাকার অঙ্ক শুনে প্রথমে চমকে ওঠেন পরিবারের সদস্যরা। প্রথমে কিছুটা আপত্তি তুললেও শেষে মোহাম্মদ আলীর কথাই চূড়ান্ত হয়। দুই সন্তান ও পুত্রবধূরাও বাবার এই কাজে খুশি ও গর্বিত বলে তিনি জানান। আত্মীয়স্বজনরাও ফোন করে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। প্রশংসায় ভাসছেন সবদিক থেকে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার টাকা দান করে ৫০ শতাংশ আত্মতৃপ্তি পেয়েছি। পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্ত সেদিন হব, যেদিন আমার এই টাকার মাধ্যমে কোনো শিশু ক্যানসার নিরাময় করে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে। এটা আমি দেখে যেতে চাই।’
চমেক রোগী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ সাহা বলেন, ‘মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কাজী মোহাম্মদ আলী। মানুষ যেখানে তারা সারা জীবনের সঞ্চয় সম্পদের জন্য বিনিয়োগ করেন, সেখানে তিনি ক্যানসার রোগীদের জন্য সব সঞ্চয় দান করে দিয়েছেন।’