‘এখন আমরা খাব কী আর মহাজনকে দেব কী?’ ডুবে যাওয়া হাওরের ফসলের দিকে তাকিয়ে এ আর্তনাদ সুনামগঞ্জের কৃষক লোকমান আহমদের।
সদর উপজেলার দেখার হাওরে ৩ একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলেন তিনি। এ কাজের জন্য উচ্চ সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ করেছিলেন। সেই ধান তলিয়ে যাওয়ায় ঋণ শোধের দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাকে।
আফসোস করে তিনি বলেন, ‘অর্ধেক ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এর আগে খড়ায় কিছু ধান নষ্ট হয়েছে। এখন যে ধান আছে তাতে খরচই উঠবে না। এখন সারা বছর চলব কীভাবে আর ঋণই বা কীভাবে শোধ করব?’
নিজেই আবার নিজেকে সান্ত্বনা দেন এই বলে, ‘আল্লাহ মারলে কিচ্ছু করার নাই’।
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় এখন লোকমানের মতো অন্য কৃষকদের একই আর্তনাদ। চোখের সামনে তলিয়ে যাচ্ছে তাদের স্বপ্নের ফসল। সবার মুখে একই প্রশ্ন, ‘এখন আমরা খাব কী?’
বেশির ভাগ কৃষকের অবশ্য এখন আফসোস-আর্তনাদ করারও সময় নেই। যেটুকু ফসল টিকে আছে, সেগুলো বাঁচাতে লড়াই করছেন তারা। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধানও কেটে নিচ্ছেন অনেকে। তাতে যদি কিছু পাওয়া যায় সে আশায়।
আশরাফ আলী তাদের একজন। দেখার হাওরেই আশরাফের জমি। ধান এখনও পুরোপুরি পাকেনি। তবে ঢল আতঙ্কে সেই আধাপাকা ধানই তিনি কেটে নিয়ে আসছেন।
আশরাফ বলেন, ‘এখানে ১২ একর জায়গায় আমি বোরো ধান করেছিলাম। চার একর ধান নষ্ট হইছে। পানি আসায় ধান পাকেও নাই ভাল করে, তবু আধাকাঁচা ধান কেটে আনা লাগছে।
‘রোজ সকালে ভয় নিয়ে ঘুম ভাঙে। আজ হাওরে কী হবে, সেই ভয় থাকে। রোজ ঘুম থেকে উঠে দেখি একটু একটু করে পানি বাড়ে।’
সরেজমিনে সদর উপজেলার দেখার হাওর এবং বিশ্বম্ভরপুরের খরচার হাওর ঘুরে সোমবার দেখা যায়, ঢলে এখন হাঁটুপানি। কৃষকরা পানিতে নেমেই ধান কাটছেন। যার মধ্যে অনেক ধান নষ্ট হয়েছে গেছে বলে জানান তারা।
ধান বাঁচাতে স্বামীর সঙ্গে কাজ করছেন বিশ্বম্ভরপুরের খরচার হাওরের রিনা বেগম। স্বামী কাঁচা ধান কেটে নিয়ে আসছেন, তিনি সেগুলো শুকিয়ে নিচ্ছেন।
রিনা বলেন, ‘সামনে ঈদ আসছে, ছেলেমেয়েরা কত আশা করে রেখেছিল যে ধান হবে, তাদের কাপড় কিনে দেব। এখন কাঁচা ধান কেটে ঘরে আনা লাগছে। এসব দেখলে আর ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকালে বুক ফেটে যায়। আল্লাহ এখন বাঁচাবেন, আর নিয়ে নিলে নিয়ে নেবেন।’
হাওরপ্রধান জেলা সুনামগঞ্জে বছরে এই একবারই ফসল হয়। ফলে বোরো ধানই এখানকার বেশির ভাগ মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। অকাল বন্যায় যে বছর ধান তলিয়ে যায়, সে বছর চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় এখানকার কৃষকদের।
এবারও কোথাও বাঁধ ভেঙে, কোথাও বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করছে হাওরে, তলিয়ে যাচ্ছে ফসল। গত ২ এপ্রিল তাহিরপুর উপজেলার নজরখালি বাঁধ ভাঙার মধ্য দিয়ে হাওরে পানি প্রবেশ শুরু হয়। সবশেষ সোমবার সকালে দিরাই উপজেলার একটি বাঁধ ভেঙে হুরামন্দিরা হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। সেখানকার ৩০০ হেক্টর জমির ধান এখন হুমকিতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, সোমবার সকাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত প্রায় ৬১ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে, যা আবাদ হওয়া মোট ধানের ৩৭ শতাংশ।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘হাওরের খুব কঠিন সময় পার হচ্ছে। নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকলে একটিও বাঁধ টিকবে না। তাই এখন আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, যেন উজানে বৃষ্টিটা কমে যায়।’
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ‘গেল ১৮ দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১ হাজার ৯৭১ দশমিক ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার কারণে পাহাড়ি ঢলে আকস্মিকভাবে হাওরের পানি বাড়তে শুরু করে।’