নির্বাচনে কোনো দল না আসতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার থাকে না বলে মন্তব্য করেছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার না হলে ভোটে না আসার ব্যাপারে বিএনপির হুমকির মধ্যে এমন মন্তব্য এলো তার কাছ থেকে।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে আয়োজিত সংলাপ শেষে এমন মন্তব্য করেন সিইসি।
গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পর এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো সংলাপে বসল কমিশন। এই দফায় আলোচনা করা হয় ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে।
সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনে কে অংশ নেবে আর কে নেবে না, সেটা ফোর্স করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে দায়িত্ব থাকবে আহ্বান করা যে আপনারা আসুন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন।’
তবে অংশগ্রহণমূলক ভোটই দেখতে চান সিইসি। বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ না নিলে কিন্তু গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। সবাইকে চেষ্টা করতে হবে একটা সুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। আমরা অর্থহীন সংলাপ করছি না।’
নির্বাচনে সব পক্ষ এলে তাতে ভারসাম্য ঠিক থাকে বলেও মন্তব্য করেন সিইসি। বলেন, ‘নির্বাচনে যদি দুটো পক্ষ থাকে, তবে দুটো পক্ষকে খেলতে হবে, তাহলে নির্বাচনটা ওইদিক থেকে সহজ হয়।’
ভোট সুষ্ঠু করতে কমিশন সৎ অবস্থানে থাকবে বলেও নিশ্চয়তা দেন সিইসি। বলেন, ‘আমাদের সৎভাবে দায়িত্ব পালনের স্পৃহা ও চেষ্টা আছে, থাকবে। ব্যাপক অনিয়মের তথ্য আমাদের কাছে এলে, সাহস নয়, আমাদের দায়িত্ব হয়ে যাবে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার। অনেক বিধান আমাদের অনুকূলে থাকলেও তা প্রয়োগের হার বাড়াতে হবে।’
নির্বাচনকে হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে যা যা করতে হয়, তার সব করা হবে বলেও নিশ্চয়তা দেন সিইসি। কমিশন প্রধান বলেন, ‘তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন তা নিশ্চিত করা। অনেক সময় কারচুপি হয়, সেটা রোধ করতে হবে। আমরা আমাদের সামর্থ্য, দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করব।’
বাংলাদেশে ভোট নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ১৯৮৬ সালে বিএনপি, ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সমমনাদের, ১৯৯৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ সে সময়ের বিরোধী পক্ষের ভোট বর্জন দেখেছে দেশ।
এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুটি নির্বাচনে সবাই অংশ নিলেও নবম সংসদ নির্বাচনের আগে আবার বিরোধ তৈরি হয়।
ওই নির্বাচনের আগে প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা হয় কে এম হাসানের। তিনি অতীতে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এ কারণে তার অধীনে ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ সে সময়ের বিরোধী পক্ষ।এ নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সবার অংশগ্রহণে হয় জাতীয় নির্বাচন।
এরপর ২০১৪ সালে আবার ভোট বর্জন দেখে দেশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোট বর্জন করে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনাদের পাশাপাশি বামপন্থিরাও। তবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আবার আসে সব পক্ষ।
তবে ২০১৮ সালের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি- এমন অভিযোগ তুলে বিএনপি আবার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি তুলছে। না হলে আগামী নির্বাচনে না আসার ঘোষণা আছে তাদের। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আদালতের আদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। সেটি ফেরানো আর সম্ভব নয়।
ভোটের সময় সরকার ব্যবস্থা কী হবে- এটার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভোটগ্রহণ পদ্ধতি নিয়েও বিভেদ আছে। নির্বাচন কমিশন ব্যালটের বদলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমে ভোট নিতে চায়। এতে আওয়ামী লীগের আপত্তি না থাকলেও বিএনপি এই যন্ত্র ব্যবহারের বিপক্ষে।
নির্বাচন নিয়ে আগের সংলাপে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি ইভিএম ব্যবহার না করার প্রস্তাব দেয়ার পর বিএনপি তার বক্তব্যের প্রশংসা করে।
সিইসি এ প্রসঙ্গেও কথা বলেন। বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে এ নিয়ে কয়েকটি মিটিং করেছি। যেহেতু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু ইভিএমের সুবিধাটা হলো, এটি পেশিশক্তির ব্যবহার হ্রাস করতে পারে, যেখানে সিল দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরা যায় না। কাজেই ইভিএমের ভালো দিক আছে। আমরা ইভিএম নিয়ে স্টাডি করছি, যেটা জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছেন।’
সংলাপে কেন্দ্রের ভেতরের স্বচ্ছতায় জোর দেন আলোচকরা। সিইসি বলেন, ‘ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে যদি আপনাদের দেখাতে পারি, কেন্দ্রের ভেতরে যদি ক্যামেরা থাকে, বাইরে যদি মনিটরে দেখা যায়, এগুলো নিয়ে কথা হয়েছে।
‘এগুলো নিয়ে আমার সহকর্মীরাও বিশ্বাস করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বিচরণ যদি থাকে, তারাও রিপোর্ট করতে পারবেন। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এসব বিষয়ের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। আমাদের সাধারণভাবে ওপেন হতে হবে। তথ্য দিতে হবে বলে মনে করি।’