বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হওয়া খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমতুল্লাহ।
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে এই ক্ষমা প্রার্থনা করেন তিনি।
এ সময় এক প্রশ্নে অধ্যাপক রহমতুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে মুজিবনগর সরকারের অবদানের কথা বলতে গিয়ে আমি এই সরকারের মন্ত্রণালয়ে যারা ছিলেন তাদের সবার নাম উচ্চারণ করেছি।
‘তবে সেগুলোর মধ্যে এই নাম (খন্দকার মোশতাক) উচ্চারণ করাটা আমার ইচ্ছার বাইরে ছিল। এটাই হয়তো বা একটি ইস্যু হয়েছে। আমি জানি না, আমার ভুলটা কোথায়? যদি এই নাম উচ্চারণ করাটা আমার ভুল হয়ে থাকে, তাহলে সেটির জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি।’
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার শপথ নেয়। মেহেরপুরের মুজিবনগরে এই শপথ হওয়ার কারণে দিবসটি মুজিবনগর দিবস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দিবস উপলক্ষে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দেন অধ্যাপক রহমতুল্লাহ। তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে হয় তর্ক-বিতর্ক।
একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমতুল্লাহ তার বক্তব্যে মোশতাককে শ্রদ্ধা জানানোর কথা বলেছেন। যদিও তিনি তা অস্বীকার করে বলেছেন, ‘এটা কোনো সুস্থ মানুষ করবে না।’
অভিযোগ রয়েছে, অধ্যাপক রহমতুল্লাহ আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের জাতীয় চার নেতা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চারজনকে বলে একজনকে আলাদা করে বলা, এটা মনে হয় না আমি বলেছি। তবে এটার কোনো ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। কারণ আমি তো গুছিয়ে,পরিকল্পিতভাবে কিছু বলিনি।
‘তবে আমার ধারণা, কোনো না কোনোভাবে এটি রেকর্ড হয়েছে। সেই রেকর্ডের একটা দুইটা লাইন বা শব্দ আমরা ব্যবহার করি, সামনের বা পেছনের অংশ না জানলে হয়তো বা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। আমি বলব, সেটা পুরোটা গ্রহণ করা হোক।’
ঢাবি শিক্ষক সমিতির এই সভাপতি বলেন, ‘আমার একটা বক্তব্যে যদি স্লিপ অফ টাংও হয়ে থাকে; সেটার ভিত্তিতে যদি আমাকে পুরোপুরি মূল্যায়ন করা হয়, আমাকে অন্যভাবে দেখা হয়, তাহলে আমার দুঃখ প্রকাশ ছাড়া অন্যকিছু বলার নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নয়। এখানে আমার গোপন করার কিছু নেই। শুধু তা-ই নয়, আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। এখানে গোপন করার কিছু নেই।’
লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক রহমতুল্লাহ বলেন, ‘গতকাল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত আলোচনাকালে মুজিবনগর সরকারে কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তা উল্লেখ করি এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। আমার বক্তব্যের একপর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কুলাঙ্গার এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ও পরবর্তীকালে জাতির সঙেগ বিশ্বঘাতকতাকারী বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোস্তাক আহমেদের প্রতি আমি আমার ব্যক্তিগত ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করি।
‘গতকালের আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদানকালে আমি যদি অজ্ঞতাবশত কোনো শব্দ/বাক্য উচ্চারণ করে থাকি তা নিতান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত ভুল। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
টিএসসিতে রোববারের সভায় উপস্থিত একাধিক অধ্যাপক নিউজবাংলাকে জানান, লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক রহমতুল্লাহ বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের জাতীয় চার নেতা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’
সভায় উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সামাদ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান। তিনি এই বক্তব্যকে ধৃষ্টতাপূর্ণ উল্লেখ করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের প্রতি এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানান। এরপর উপাচার্য শিক্ষক সমিতির সভাপতির বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক সামাদ বলেন, ‘খন্দকার মোশতাকের মতো ব্যক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানীও শিক্ষক সমিতির সভাপতির বক্তব্যকে ধৃষ্টতাপূর্ণ উল্লেখ করে অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক একটি প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধুর খুনির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করাটা ধৃষ্টতা। এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আমি মনে করি, নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর প্রতিকার হওয়া এবং ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
ওই ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অধ্যাপক রহমতুল্লাহ তার বক্তব্যে মূলত মুজিবনগর সরকারে বেশ কয়েকজনের নাম নিয়েছেন। সেই নামের মধ্যে খন্দকার মোশতাকের নামও ছিল। এরপর তিনি মোশতাকের সমালোচনা এবং তার প্রতি ঘৃণা জানিয়েছেন।
‘পরে সভাপতি হিসেবে আমি তার প্রথম বক্তব্য অর্থাৎ যেখানে তিনি অন্যদের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের নাম নিয়েছেন সেই অংশ এক্সপাঞ্জ করেছি।’
মোশতাক যে কারণে নিন্দিত
খন্দকার মোশতাক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন তিনি।
তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ভূমিকা এই হত্যায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে আসে বলে ধারণা করা হয়। জাতির পিতাকে হত্যার দিন থেকে ওই বছরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৩ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
এই সময়েই তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার থেকে অব্যাহতি দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। পরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সেটি সংবিধানের অংশ করা হয়।
তার শাসনামলেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়।
ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ নামক এক নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় এবং আদালত তাকে পাঁচ বছরের শাস্তি দেয়।
জেল থেকে মুক্তির পর তিনি আবার সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। তবে সুবিধা করতে পারেননি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার বছরে ৫ মার্চ মারা যান খন্দকার মোশতাক। এ কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি।