বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে একটা সময়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষয়িষ্ণু প্রবণতা তৈরি হয়। সেই অবস্থা থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে চারটি মৌলিক নীতি-কৌশল বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এগুলো হলো- সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, প্রণোদনা প্যাকেজ গঠন ও বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ এবং অর্থের যোগান বাড়ানো।
সরকারের নেয়া সেসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সুফল অর্থনীতিতে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। আর এর ওপর দাঁড়িয়ে অর্থনীতির সব সূচকেই স্বস্তি দেখছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ইতোমধ্যে ৯ মাস পার হয়ে গেছে। এই সময়ে রাজস্ব আয়, রপ্তানি, রিজার্ভ, রেমিটেন্স, আমদানি, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পজাত কাঁচামালের ঋণপত্র খোলার হার, বেসকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি, সরকারি ব্যয়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার, কৃষি ঋণ বিতরণ এবং সরাসরি বৈদেশিক নিট বিনিয়োগে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি উন্নতি ঘটেছে।
অর্থনীতির মানদণ্ড নির্ধারক এসব সূচকের ইতিবাচক প্রবণতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে মনে করছে সরকার। বলা হচ্ছে, এর ওপর দাঁড়িয়ে দেশ দ্রুতই ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির কাতারে ফিরতে সক্ষম হবে।
সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশনের কাউন্সিলের দ্বিতীয় বৈঠকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেশের অর্থনীতি এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়েছে।
সূত্রমতে, রোববার অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের ভার্চুয়ালি এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বৈঠকে দেশের অর্থনীতির সার্বিক চালচিত্রের হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরাসহ সেই আলোকে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট কেমন হতে পারে তারও একটি সম্ভাব্য রূপরেখা অর্থমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করেন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, হালনাগাদ পাওয়া তথ্য-উপাত্ত এটাই স্পষ্ট করছে যে, রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিকে কাবু করতে পারেনি। বরং করোনায় ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে সরকার যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছে তা রুগ্ন দশা কাটিয়ে চলমান অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, চলমান অর্থনীতির এই মজবুত অবস্থান অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতির ঝুঁকি থেকেও সরকারকে দুশ্চিন্তামুক্ত রেখেছে। তবে আগামীতে রিজার্ভ ব্যবহারে সতর্ক হবে সরকার। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে দেশের অর্থনীতি সব ধরনের আশঙ্কামুক্ত থাকবে।
কেন এই স্বস্তি
কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার ২০২১-২২ অর্থবছরের সার্বিক অর্জন সংক্রান্ত একটি হালনাগাদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
প্রতিবেদনে অর্থসচিব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলার চেষ্টা করেন, বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও সবদিক বিবেচনায় খুবই ভাল অবস্থানে রয়েছে দেশের অর্থনীতি।
অর্থ সচিবের উপস্থাপিত তথ্যমতে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এটা চলতি অর্থবছরে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ৫৬ দশমিক ১১ শতাংশ। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এই অর্জন ছিল ৫৫ দশমিক ০৩ শতাংশ।
সরকারি ব্যয়েও প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ে সরকারি ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এটা বাজেটে মোট সরকারি ব্যয়ের ৩৭ দশমিক ৫৬ শতাংশের সমান। আগের বছর একই সময়ে এই ব্যয় হয়েছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকা।
ঘাটতি পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছে। গত আট মাসে বাজেট ঘাটতি মাত্র চার হাজার কোটি টাকা, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম।
এডিপি বাস্তবায়ন ব্যয়ও আগের বছরের তুলনায় বেশি। এই সময়ে মোট এডিপি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা মোট এডিপি বাস্তবায়নের ৩৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৬০৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
প্রবৃদ্ধি ঘটেছে বেসরকারি খাতে ঋণ চিত্রেও। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮১ দশমিক ০৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে এর হার ছিল মাত্র ১ দশমিক ২৭ শতাংশ।
কৃষিঋণ বিতরণ হয়েছে ১৩ হাজার ৪৩৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ, যা আগে ছিল ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
অর্থবছরের ৯ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এটা ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। এছাড়া জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত মাসের আমদানি হিসাবের (সিঅ্যান্ডএফ) ব্যয় হয়েছে ৪২ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির উদ্দেশ্যে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫২ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের। যেখানে মূলধনী যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলা হয় ৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার এবং শিল্পজাত কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয় ১৯ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের।
অন্যদিকে সরাসরি বৈদেশিক নিট বিনিয়োগ এসেছে ৮৭ কোটি ডলারের।
এছাড়া গত ২৪ মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের।
অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, চাহিদার দিক থেকে প্রবৃদ্ধির সঞ্চালক সূচকগুলোর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি, কৃষি ঋণ বিতরণ ও সার্বিক ঋণপত্র খোলা, শিল্প জাত কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার মতো অর্থনীতির এই উল্লেখযোগ্য সূচকগুলোর ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দ্বারা বিরাজ করছে। এটা আগামী মেয়াদে অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে।
তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা বিরাজ করছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে ১২ মাসের গড়ভিত্তিক সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এটা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি শেষে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় এখন এই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কৌশলী পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করবে। এজন্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বন্ধ করা হবে বিলাসী ও অযাচিত পণ্যের আমদানি।
যে কারণে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধিতে থাকবে দেশ
কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে মতামত তুলে ধরে বলা হয়, দেশে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবহার। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়, যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
আমদানি-রপ্তানির ইতিবাচক প্রবাহ আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির ফলে সার্বিক কর্মসংস্থান বাড়বে।
সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত ১ লাখ ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের ফলে শিল্প খাত বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং সেবা খাতে চাঙ্গা ভাব অব্যাহত থাকবে।
গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে গতির সঞ্চার ঘটবে, যা উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।
কৃষি খাতে প্রণোদনা, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এর স্বল্প সুদে ঋণ/ভর্তুকির ফলে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
এসব কিছুর সুফল সমন্বিতভাবে দেশকে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। যেমন হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছর-পূর্ববর্তী সময়ে।