মুজিবনগর দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হওয়া ‘খোন্দকার মোশতাক আহমেদ’কে নিয়ে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে হুলুস্থুল হয়ে গেল।
একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক রহমতুল্লাহ তার বক্তব্যে মোশতাককে শ্রদ্ধা জানানোর কথা বলেছেন। যদিও তিনি তা অস্বীকার করে বলেছেন, ‘এটা কোনো সুস্থ মানুষ করবে না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামানও বলেছেন, অধ্যাপক রহমুল্লাহ খোন্দকার মোশতাককে শ্রদ্ধা জানাননি। মুজিবনগর সরকার নিয়ে আলোচনায় সেই সরকারের সদস্য হিসেবে মোশতাকের নাম এসেছিল।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার শপথ নেয়। মেহেরপুরের মুজিবনগরে এই শপথ হওয়ার কারণে দিবসটি মুজিবনগর দিবস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
দিবস উপলক্ষে রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দেন অধ্যাপক রহমতুল্লাহ। তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে হয় তর্ক বিতর্ক।
সভায় উপস্থিত একাধিক অধ্যাপক নিউজবাংলাকে জানান, লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক রহমতুল্লাহ বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের জাতীয় চার নেতা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’
সভায় উপস্থিত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সামাদ তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানান। তিনি এই বক্তব্যকে ধৃষ্টতাপূর্ণ উল্লেখ করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের প্রতি এই বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবি জানান। এরপর উপাচার্য শিক্ষক সমিতির সভাপতির বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক সামাদ বলেন, ‘খোন্দকার মোশতাকের মতো ব্যক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানীও শিক্ষক সমিতির সভাপতির বক্তব্যকে ধৃষ্টতাপূর্ণ উল্লেখ করে অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক একটি প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধুর খুনির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করাটা ধৃষ্টতা। এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আমি মনে করি নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর প্রতিকার হওয়া এবং ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
‘অভিযোগটি একদমই সত্য নয়’তবে বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন অধ্যাপক রহমতুল্লাহ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি একদমই সত্য নয়। আলোচনা করতে গিয়ে মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বলেছি। এই সরকারে যে ১৫টা মন্ত্রণালয় ছিল, সেই মন্ত্রণালয়গুলো যাদের অধীনে ছিল, শুধুমাত্র তাদের নাম আমি উল্লেখ করেছি।’
‘আমি মুজিবনগর সরকারের কে কোন মন্ত্রণালয়ে ছিল, সেটি শুধু বলেছি। আমি এখানে সকলের নাম বলেছি, একজনের নাম বলিনি। এখন কেউ যদি বলে ওদেরসহ মোশতাকের প্রতি আমি আলাদাভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি, তাহলে তো আমি বিকৃত মানসিকতার মানুষ। আমি মনে করি, এখানে বিষয়টাকে অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে বা অন্য কোনোভাবে ব্যাখা করা হচ্ছে।’
অধ্যাপক রহমতুল্লাহ বলেন, ‘আমি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। আমি একজনকে হাইলাইট করে শ্রদ্ধা জানাব কেন? যারা নতুন করে এটি বলছে আমি মনে করি তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।’
প্রশংসা তো দূরের কথা, খোন্দকার মোশতাকের নিন্দাও করেছেন বলে জানান অধ্যাপক রহমতুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘মোশতাক সম্পর্কে আমি বলেছি, তার কলঙ্কিত কাজের জন্য আমি ব্যাক্তির পক্ষ থেকে নিন্দা জানাই। সে ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ব্যক্তিত্ব।
‘শুধু এগুলো নয়, আমি আরও বলেছি, ১৭ এপ্রিল শপথ নেওয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ আট মাস শরণার্থীদের রক্ষা করা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তৈরি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জন করাসহ বিভিন্ন কাজ এই সরকার করেছে। এছাড়া যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই সরকার কীভাবে কাজ করেছে সে কথাগুলোও আমি বলেছি।’
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়গুলো না নিয়ে শুধুমাত্র প্রবাসী একজন মন্ত্রীকে হাইলাইট করে বলব, আমার মনে হয় না আমি এটা বলেছি। তবে এখানে যদি কোন স্লিপ অব টাং হয়ে থাকে তবে সেজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করব। তবে স্বজ্ঞানে আমি এমন কথা বলেছি বলে মনে হয় না।
‘কে কীভাবে এটির ব্যাখ্যা করছে আমি জানি না। আমার কোনো হীন উদ্দেশ্য এখানে ছিল না। আমি নতুন করে কোন ইতিহাস লিখতে চাইনি। সেই দুঃসাহস আমার নেই। এটা করা আমার পক্ষে সমীচীনও নয়।’
উপাচার্য যা বলছেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অধ্যাপক রহমতুল্লাহ তার বক্তব্যে মূলত মুজিবনগর সরকারে বেশ কয়েকজনের নাম নিয়েছেন। সেই নামের মধ্যে খোন্দকার মোশতাকের নামও ছিল। এরপর তিনি মোশতাকের সমালোচনা এবং তার প্রতি ঘৃণা জানিয়েছেন।
‘পরে সভাপতি হিসেবে আমি তার প্রথম বক্তব্য অর্থাৎ যেখানে তিনি অন্যান্যদের সঙ্গে খোন্দকার মোশতাকের নাম নিয়েছেন সেই অংশ এক্সপাঞ্জ করেছি।’
মোশতাক যে কারণে নিন্দিত
খোন্দকার মোশতাক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন তিনি।
তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার ভূমিকা এই হত্যায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে আসে বলে ধারণা করা হয়। জাতির পিতাকে হত্যার দিন থেকে ওই বছরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৩ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
এই সময়েই তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদেরকে বিচার থেকে অব্যাহতি দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। পরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সেটি সংবিধানের অংশ করা হয়।
তার শাসনামলেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে হত্যা করা হয়।
ক্ষমতা থেকে বিতারিত হওয়ার পর ১৯৭৬ সালে মোশতাক ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামক এক নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় এবং আদালত তাকে পাঁচ বছরের শাস্তি দেয়।
জেল থেকে মুক্তির পর তিনি আবার সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। তবে সুবিধা করতে পারেননি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার বছরে ৫ মার্চ মারা যান খোন্দকার মোশতাক। এ কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি।