অভাবের কারণে দুই বছর আগে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রানী আক্তার। তিনি পেশায় ইটভাটার শ্রমিক।
ঋণ নেয়ার সময় চুক্তি হয় মাসে ৪ হাজার টাকা সুদ পরিশোধের। ঋণ শোধ না হলে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে সেই টাকা।
অভাবের কারণে প্রতি মাসে সময়মতো সুদ পরিশোধ করতে পারেননি রানী। দুই বছর ধরে টানছিলেন ঋণের সুদের বোঝা।
রানীর অভিযোগ, তার কাছ থেকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা নেয়ার পরও আরও ১ লাখ ৩ হাজার টাকা দাবি করা হয়।
অর্থাৎ ৫ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে তাদের কাছ থেকে দাবি করা হয় মোট ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ সুদ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮ হাজার টাকা।
সেই টাকা আদায়ে বিক্রি করে দেয়া হয় তার এক দিনের নবজাতককে। সেই শিশুর বয়স এখন প্রায় এক বছর।
ওই শিশুটিকে উদ্ধার করে রোববার দুপুরে ফতুল্লা মডেল থানায় নিয়ে এসে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে পুলিশ।
শনিবার ভোরে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা এলাকার দক্ষিণ পাশা এলাকা থেকে ওই শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সুদের টাকার জন্য আবারও চাপ সৃষ্টি করা হলে ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার আলীগঞ্জ পিডব্লিউডি কলোনিতে। পরে সেখান থেকে ঘটনা জানতে পারে পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান বলেন, ‘সুদের টাকার জন্য বাচ্চা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে, স্থানীয়দের মাধ্যমে এমন খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে রানু বেগম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে। পরে তার দেয়া তথ্যের মাধ্যমে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়।’
ঘটনার বর্ণনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘অভাবের কারণে ওই এলাকার লাকী নামে এক নারীর কাছ থেকে দুই বছর আগে ৫ হাজার টাকা ঋণ নেন রানী। সেই ঋণের টাকার শুধু সুদ বাবদ ২ লাখ ১০ হাজার টাকা তার কাছ থেকে আদায় করা হয়। এরপর আরও ১ লাখ ৩ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে বলে রানীর কাছে দাবি করেন লাকি। এ জন্য তাকে নানা সময় মারধরের ভয়ভীতি দেখানো হতো।
‘তদন্তে পাওয়া গেছে, রানীর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়েছেন লাকী নামের ওই নারী। তিনি মূলত ঋণ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করে আসছিলেন। তাকে সহযোগিতা করতেন তার বাবা মোহাম্মদ আজাদ ও স্বামী হজরত আলী। তারা দুজন চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী। কলোনির আরও অনেক দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে এভাবে টাকা আদায় করতেন তারা।’
মায়ের কোলে সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে রোববার সংবাদ সম্মেলন করেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুল হাসান। ছবি: নিউজবাংলা
সুদের জালে সন্তান হারালেন যেভাবে
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘রানীর গর্ভে সন্তান জন্ম নেয় গত বছরের এক ভোররাতে। ওই দিন বিকেল ৫টার দিকে সেই শিশুকে ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন লাকী। বিনিময়ে টাকা মওকুফের কথা জানান।
‘গত বৃহস্পতিবার লাকী আবারও রানীর কাছ থেকে টাকা দাবি করেন। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হলে এলাকার মানুষ ঘটনা জানতে পারে।’
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় লাকীকে আসামি করে মামলা করেন রানী। পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শনিবার ভোরে মুন্সীগঞ্জ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে। এ সময় রানুকে আটক করা হয়। তিনি মূলত শিশুটিতে কিনেছিলেন।’
রানী তার স্বামী নির্মাণশ্রমিক হান্নান চৌকিদারের সঙ্গে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বাদুরতলা থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার দাপা এলাকায় এসেছিলেন। সেখানে তার স্বামী নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন আর রানী শুরু করেন ইট ভাঙার শ্রমিকের কাজ। সেখানে ঘর ভাড়া নেন আজাদের বাড়িতে।
যেভাবে ফাঁদে পড়েন রানী
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রানী পড়াশোনা জানেন না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন লাকী ও তার স্বামী হজরত আলী। তারা ঋণ দেয়ার সময় তার কাছ থেকে কাগজে সই নেন। সেই কাগজ দেখিয়ে থানায় মামলা করা যাবে, পালিয়ে গেলেও পুলিশ দিয়ে ধরে আনা হবে এমন ভয় দেখিয়ে টাকা নেয়া হতো। তাদের হুমকি আর মারধরের ভয়ে এক বছর আগেই রানীর স্বামী রানীকে রেখে চলে যান। এরপর আর ফেরেননি।
রানীর যখন সন্তান হয়, সেই সন্তান বিক্রির পরও বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকি দেয়া হয়। তারা এখানেই থেমে থাকেননি। ইট ভেঙে যে আয় হয়েছে তা দিয়ে সুদের টাকা নেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এমনকি রানীকে দিয়ে তাদের বাড়িতে আয়ার কাজও করিয়েছেন।
ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান বলেন, ‘আমরা রানীর করা মামলার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রেনু বেগমকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার দেখিয়েছি। মূল আসামি লাকীসহ তার স্বামীও পলাতক।
‘তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে। রানীকে তার সন্তান ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’