বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শহীদুলের ‘মধু পরিবার’

  •    
  • ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ০৮:৩৯

প্রাণিকুলের প্রতি মানুষের অকারণ নিষ্ঠুরতা দেখে শহীদুলের মধ্যে অনুতাপ জন্ম নেয়। সেই থেকে অনেক প্রাণী উদ্ধার করে তাদের সারিয়ে তুলেছেন তিনি। সেগুলোর বেশির ভাগকে নিজে লালন-পালন করেছেন। প্রাণীগুলো হয়ে উঠেছে তার ‘পরিবার’।

কাঁধে ইগল ও বুকে বানর নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন শহীদুল। আদর করে তাদের নাম দিয়েছেন ‘মধু পরিবার’। মাঝেমধ্যে সঙ্গী হতো কুকুর ‘ডলার’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাকে দেখে প্রথম দফায় অবাক হতেন শিক্ষার্থীরাও।

ছোটবেলা থেকেই বাউণ্ডুলে স্বভাবের ছেলে শহীদুল। পুরো নাম শহীদুল ইসলাম শহীদ। পড়ছেন চবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। পশুপাখির প্রতি তার অগাধ প্রেম জন্মেছে অনুতাপ থেকে।

শহীদুল জানান, ছোটবেলায় দুষ্টুমির ছলে ফাঁদ পেতে পাখি মারতেন। এর বাইরেও ছোটবেলা থেকে দেখেছেন গ্রামের লোকেরা বিদ্যুতের ফাঁদ তৈরি করে চিতাবাঘ, শিয়াল, হাতি, সাপ মেরে উল্লাস করে। সবাই দলবেঁধে দেখতে আসত। নিষ্ঠুরতা তাকে ভাবিয়ে তোলে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজ আমাদের শিখিয়েছে পশুপাখি মারা গর্বের বিষয়। সবাই এটাকে পজিটিভলি নিত। কিন্তু এই বিষয়গুলো আমার মধ্যে অনুতাপের সৃষ্টি করে। আমি বোঝার পর সিদ্ধান্ত নিই যে যতদিন বাঁচি পশুপাখিকে ভালোবাসব, সেবা করব।’

সেই থেকে অনেক প্রাণী উদ্ধার ও তাদের সারিয়ে তুলেছেন শহীদুল। প্রাণীদের মায়া-মমতায় আগলে রেখে হয়েছেন তাদের প্রিয়ভাজন।

মধু পরিবারের গল্প

আদর করে শহীদুল তার উদ্ধার করা কুকুরগুলোর নাম দিয়েছেন ডলার। এর বাইরে বাকিদের নাম দিয়েছেন মধু। মধু পরিবারে তার উদ্ধার করা প্রাণীদের মধ্যে আছে মেছোবাঘ, প্যাঁচা, সাপ, তক্ষক, বেজি, ইগল ও বানর। এদের তিনি মধু বলে ডাকেন। ইগলকে ডাকতেন ইগল মধু, বানরকে ডাকতেন বানর মধু। ইগল ও বানর তার সঙ্গেই থাকত।

ইগল মধুকে শহীদুল গত বছর লকডাউনের বন্ধে উদ্ধার করেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা থেকে। শহীদুল বলেন, ‘ইগলটি গোল্ডেন ইগল ছিল। তার একটি চোখ ছিল নষ্ট। এটি একটি গাছের ওপর ছিল। গাছ কাটায় ইগলের বাসা ভেঙে ও নিচে পড়ে যায়। এলাকার ছেলেরা না বুঝে খুঁচিয়ে তার একটি চোখ নষ্ট করে ফেলেছে। ইগলের মুখের ভেতরেও ক্ষত করে ফেলে।’

অসুস্থ ইগলটিকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রাখেন শহীদুল। প্রায় ১১ মাস সেটা তার কাছেই ছিল। উড়তে না পারায় কাঁধে কাঁধে সে ঘুরে বেড়াত। তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী সেটিকে সুস্থ করে তোলেন।

দুই বছর আগে বানর মধুকে শহীদুল উদ্ধার করেন খাগড়াছড়ি থেকে। হলের বড় ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারেন বানর মধুর কথা। একটি বানরছানা কাদায় আটকে গেছে। পরে তাকে উদ্ধার করে মুক্ত করলে দেখা যায় অন্য বানররা তাকে গ্রহণ করছে না। সেই বানরটির আশ্রয় হয় শহীদুলের কাছে।

শহীদুল বলেন, ‘আমি খাগড়াছড়ি গিয়ে বানরটাকে নিয়ে আসি। সে শুরু থেকেই আমার সঙ্গে ছিল। আমার পরিবারের সদস্যের মতো হয়ে গেছিল। সব কিছু বুঝতে পারত। আমার কিংবা আমাদের পরিবারের মন ভালো না থাকলে সেটাও বুঝতে পারত। সার্বক্ষণিক দুষ্টুমি করে সবাইকে মাতিয়ে রাখত। আমার প্রতি অনেক টান ছিল, আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। আমাকে না দেখলে অস্থির হয়ে যেত।’

সঙ্গী ছিল ডলারও

বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে একটি কুকুর ছানাকে উদ্ধার করে নিজের কাছে রাখেন শহীদুল। অসুস্থ সেই কুকুরকে সেবা করে সারিয়ে তোলেন। নিজের আবাসিক হলে সেই কুকুরকে রাখতেন। ফলে হলের যে ব্লকটিতে শহীদুল থাকতেন, সেটি ডলার ব্লক নামেও অনেকে চিনত।

শহীদুল বলেন, ‘ডলারের ১৩টি বাচ্চা হয়। সেগুলোকে বাঁচানো ও ডলারকে বাঁচাতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক বাচ্চা মারা গেছে। অন্য কুকুরের আঘাতে ডলার আহত হয়েছিল। সে সময়ও আমি তাদের সারিয়ে তোলার চেষ্টা করি। ডলারের সঙ্গে ভালোই সখ্য গড়ে উঠেছিল। লকডাউনের বন্ধে ডলারকে রেখে যেতে হয়েছিল। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতাম। এখনও ডলার বলে ডাক দিলে আশপাশে থাকলে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসে।’

শহীদুল বলেন, ‘প্রাণীদের মধ্যে কুকুর এ দেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। কিন্তু আমার কাছে সেটা না। তাই এরা আমার কাছে ডলারের মতো দামি, এ জন্য ডলার নাম দিয়েছি।’

ইচ্ছা প্রবল, সামর্থ্য কম

বানর ও ইগলকে নিজের কাছে কেন রেখেছিলেন– এই প্রশ্নের জবাবে শহীদুল বলেন, ‘আমি বানর ও ঈগলকে নিজের কাছে রেখেছিলাম সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে। সবাই এদের দেখে আনন্দ পায়, আগ্রহ প্রকাশ করে। আমি বোঝাতে চেয়েছি, প্রাণীরা ক্ষতিকর নয়। তারাও মানুষের বন্ধু হতে পারে। তারাও পরিবেশের জন্য দরকারি।’

তিনি বলেন, ‘আমি অনেক যত্ন করে তাদের রেখেছিলাম। আমার সামর্থ্যে যা ছিল তা দিয়েছি। এর বাইরে হলের ক্যানটিনে, ডাইনিংয়ে অনেকের কাছে এদের জন্য খাবার চাইলে সবাই একটু একটু করে দিয়েছে, এতেই হয়ে যায়।’

কিন্তু এতে বাদ সাধে ইগল মধুর অসুস্থতা। ইগলের চোখের সমস্যা ও অসুস্থতা বাড়তে থাকে। শহীদুল বলেন, ‘আমার এত সামর্থ্য নেই যে ইগলকে আরও ভালো চিকিৎসা দেব, খাবার দেব। পরে প্রায় চার-পাঁচ মাস আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতির মাধ্যমে ইগলকে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় দিয়ে দিই।’

আর্থিক সংকট ও সার্বিক দিক ভেবে বানর মধুকেও চিড়িয়াখানায় দিয়ে দিয়েছেন বলে শহীদুল জানান।

তাদের ছেড়ে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে শহীদুল বলেন, ‘তারা আমার সন্তান, তাই এখনও মিস করি। সন্তানকে যদি মৌলিক চাহিদাগুলো দিতে না পারি, তারা ভালো থাকবে? তারা এখন ভালো আছে। খাবার পাচ্ছে, চিকিৎসা পাচ্ছে। আমি তাদের ভালোবাসি, মিস করি।’

এ বিভাগের আরো খবর