বুলবুল আখতার। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী। অবসর নিয়েছেন ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর। নিয়ম অনুযায়ী শেষ কর্মদিবসে তার গাড়িটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পরিবহন শাখায় বুঝিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু সে নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি এখনও ব্যবহার করে চলেছেন ‘পাজেরো স্পোর্ট’ ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি। আর সেই গাড়ির জ্বালানি ও অন্যান্য খরচও নিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে শিক্ষা প্রকৌশলের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকেই।
শিক্ষা প্রকৌশলের পরিবহন শাখা নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার বুলবুল আখতারকে ফোন ও এসএমএস করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
শুধু সাবেক প্রধান প্রকৌশলী নন, বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্বে) মো. আরিফুর রহমান নিয়মবহির্ভূতভাবে একটির বেশি গাড়ি ব্যবহার করছেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তিনি একটি গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকারভুক্ত। কিন্তু তিনি ব্যবহার করছেন বিলাসবহুল দুটি গাড়ি। এর একটি তিনি দৈনন্দিন দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করেন। আরেকটি তার পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনগুলোর সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কার এবং আসবাবপত্র সরবরাহের কাজ করে থাকে। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, আইসিটি ল্যাব স্থাপন, ইন্টারনেট সংযোগ, আইসিটি সুবিধা সরবরাহের কাজও তারা করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) প্রধান কার্যালয়ে চলমান রয়েছে ৩০টি গাড়ি। ইইডির পরিবহন ও অফিস সরঞ্জাম ব্যবহার সংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী, প্রধান প্রকৌশলী, তিনজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ছয়জন নির্বাহী প্রকৌশলী মোট ১০ জন সরকারি গাড়ি ব্যবহারে প্রাধিকারভুক্ত। বাকি ২০টি গাড়ির অধিকাংশই বিধিবহির্ভূতভাবে ব্যবহার করছেন ইইডির ক্ষমতাধর কয়েকজন কর্মকর্তা ও শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ একাধিক কর্মকর্তা, যাদের গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকার নেই।
এ ছাড়া কয়েকটি গাড়ি শিক্ষা প্রশাসনের বাইরের অন্য দপ্তরেও ব্যবহার হচ্ছে, যা অফিস সময়ের পরেও ব্যবহার করা হচ্ছে। আর কয়েকটি গাড়ি শিক্ষা প্রশাসনের ‘ক্ষমতাধরদের’ জন্য স্ট্যান্ডবাই করে রাখা হয়, যাতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িগুলো সরবরাহ করা যায়।
এ বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একাধিক গাড়িচালক নিউজবাংলাকে জানান, ‘অফিস সময় ৯টা থেকে ৫টা হলেও কর্মকর্তারা জোর করে এর পরও তাদের ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি চালাতে বাধ্য করেন।’
শিক্ষা প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দামি ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারে ইইডি ও শিক্ষা প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা কোনো নিয়ম মানছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী নিউজবাংলাকে বলেন, ইইডির গাড়িগুলো প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কবজায় থাকায় জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীরা ‘সাইট ভিজিট’ (প্রকল্প কাজ পরিদর্শন) কমিয়ে দিয়েছেন। কারণ তাদের কখনও পাবলিক পরিবহনে, কখনও একটি গাড়ি দু-তিনজন কর্মকর্তা সমন্বয় করে ব্যবহার করতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে গাড়ি নিয়ে ‘হরিলুট’ চলছে। যে যেভাবে পারছে, প্রাধিকারভুক্ত না হয়েও গাড়ি ব্যবহার করছে। আবার কিছু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে অন্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা দিচ্ছেন, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত ও অনৈতিক।”
গাড়িগুলো ব্যবহার করছেন কারা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে চালু ৩০টি গাড়ির মধ্যে মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স ও নিসান এক্স-ট্রেইল মডেলের এসইউভিই বেশি। এর মধ্যে ১০ কর্মকর্তা সরকারি গাড়ি ব্যবহারে প্রাধিকারভুক্ত। বাকি গাড়িগুলো নিয়ম অমান্য করে ব্যবহার করছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রশাসনের অন্য দপ্তরের ক্ষমতাধর কয়েকজন কর্মকর্তা।
শিক্ষা প্রকৌশলের সব পরিবহন দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন পরিবহন শাখার সহকারী প্রকৌশলী জার্জিস ইউ রহমান। অবৈধভাব গাড়ি ব্যবহারে তিনিও পিছিয়ে নেই। প্রাধিকারভুক্ত না হলেও তিনি ব্যবহার করছেন একটি গাড়ি।
বিষয়টি নিয়ে তার বক্তব্য জানতে তাকে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনি চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যান।’
এসব গাড়ির জ্বালানি খরচ ও অন্যান্য ব্যয়ের জোগান দেয় ইইডির হিসাবরক্ষণ শাখা। সেই শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. ইউনুস আলীও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। তিনিও একটি পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করছেন প্রাধিকার ছাড়া।
বিধিবহির্ভূতভাবে গাড়ি ব্যবহারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইউনুস আলী বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। আপনি প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেন।’
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের দুটি দায়িত্বে রয়েছেন আসাদুজ্জামান। তিনি প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক (প্রশাসন)। এর বাইরে তিনি উপপরিচালকের (অর্থ) অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন প্রাধিকার ছাড়া।
এ বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি জোর করে গাড়িটা ব্যবহার করছি না। নিশ্চয় অফিস থেকে গাড়িটি ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়েছে, দাপ্তরিক প্রয়োজনে। অফিস যদি অনুমোদন না করে, আমি ব্যবহার করব না।’
গাড়ি বিলাসিতায় পিছিয়ে নেই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলামও।
জানতে চাইলে বিধিবহির্ভূতভাবে গাড়ি ব্যবহারের কথা প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে একটি গাড়ি ব্যবহার করি।’
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন অন্য কয়েকটি দপ্তর এবং পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তাও ব্যবহার করছেন ইইডির বিলাসবহুল এসব গাড়ি। এ ছাড়া একাধিক গাড়ি মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের জন্য ‘স্ট্যান্ডবাই’ রাখা হয়। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন গাড়ির জন্য প্রাধিকারভুক্ত শিক্ষা প্রকৌশলের কর্মকর্তারা।
অন্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের গাড়ির সুবিধা কেন দেয়া হয়?
বিভিন্ন সময়ে অনৈতিক সুবিধা পেতেই শিক্ষা প্রকৌশলের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় কেনা গাড়িগুলো অন্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন এ দপ্তরের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী যখন-তখন গাড়ি না দিলে বিভিন্ন ফাইল আটকে দেয়া হয়। এ ছাড়া শাস্তিমূলক বদলি, পদোন্নতি আটকে দেয়ার হুমকি তো রয়েছেই। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্প পাস করতে তাদের (মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের) সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। তাই বিধিবহির্ভূতভাবে গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা দেয়া হয়।
কথা বলতে রাজি নন প্রধান প্রকৌশলী
শিক্ষা প্রকৌশলের গাড়িগুলো কেন প্রাধিকারহীন কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন এবং অন্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের কেন গাড়ি ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে– এমন প্রশ্ন করা হলে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন ইইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মো. আরিফুর রহমান।
শুরুতে বিষয়টি জানতে একাধিকবার তাকে ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। পরে তার দপ্তরে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলব না, সাক্ষাৎকার দেব না। আপনি আসতে (চলে যেতে) পারেন।’
একপর্যায়ে প্রতিবেদক এ বিষয়ে একাধিকবার মন্তব্য করতে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ‘আমি ২৮ এপ্রিল এলপিআরে (লিভ প্রিপারেশন ফর রিটায়ারমেন্ট বা অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) যাব। এরপর আপনি যোগাযোগ করবেন, সব বলব।’
‘এটা ভয়াবহ দুর্নীতি’
প্রাধিকারভুক্ত না হয়ে গাড়ি ব্যবহার এবং অন্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের অনৈতিকভাবে গাড়ি ব্যবহারে সুবিধা দেয়াকে ভয়াবহ দুর্নীতি বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘এটা সরকারি নিয়মের সুস্পষ্ট ব্যত্যয়। এটা ভয়াবহ প্রতারণা ও দুর্নীতি। যারা ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করছেন, সুষ্ঠু তদন্ত করে অবশ্যই এদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
গাড়িগুলো যারা ব্যবহার করছেন এবং যারা এ ধরনের অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছেন, উভয় পক্ষকেই জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘যারা নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব গাড়ি ব্যবহার করছেন, তারা যেমন অপরাধ করছেন, আবার যারা তাদের এ ধরনের অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছেন, তারাও সমান অপরাধে অপরাধী। তাই উভয় পক্ষকেই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
এ বিষয়ে একাধিকবার শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীককে ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
পরে এসএমএস দিলে শুধু সাড়া দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী। হোয়াটসঅ্যাপে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল লেখেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি জিজ্ঞেস (প্রধান প্রকৌশলীকে) করব। তবে গাড়ির প্রয়োজন হলে ব্যবহার করতে পারে যে কোনো সময়। বিনা প্রয়োজনে কি না সেটা দেখার বিষয়।’