এলমা চৌধুরীকে হত্যার কোনো প্রমাণ পায়নি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কানাডায় যেতে না পারা, স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-মারধর, সবশেষে বাবার বাড়িতে যেতে না দেয়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের এই শিক্ষার্থী।
গত ডিসেম্বরে এলমার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর তার স্বামী, শাশুড়ি ও শ্বশুরকে আসামি করে বনানী থানায় হত্যা মামলা হয়। মামলাটি করেন এলমার বাবা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ মামলাটি তদন্ত করে হত্যার কোনো প্রমাণ পায়নি। ফরেনসিক রিপোর্ট, আসামি ও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ, সিসিটিভি ফুটেজসহ অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণ করে ডিবি পুলিশ বলছে, এলমাকে হত্যা করা হয়নি। স্বামীর নির্যাতন ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
ডিবি গুলশানের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান জানান, মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘আগের দিন মারধর, কানাডায় যেতে না নেয়া, পরদিন বাবার বাড়িতে যেতে না দেয়ায় এলমা আত্মহত্যা করেন। আমরা এসব তথ্য ভেরিফাই করেছি। সিসিটিভি ফুটেজ, টেকনোলজি, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষী, ফরেনসিক রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এসব তথ্যের সত্যতা পেয়েছি।’
এলমার স্বামী ঘটনার পর পরই গ্রেপ্তার হন। তাকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বনানী থানা ও গুলশান ডিবি পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাবন্দি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, এলমাকে হত্যার প্রমাণ না পাওয়া গেলেও তাকে যে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করা হয়েছে তার প্রমাণ সুরতহাল ও ফরেনসিক রিপোর্টে পাওয়া গেছে। এলমার বাবা হত্যা মামলা করলেও তা আত্মহত্যায প্ররোচনা মামলায় রূপান্তরিত হবে।
এদিকে এলমার বাবা সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ডিবি পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ডিবি পুলিশ যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে সেটা কেবল আসামি পক্ষের সঙ্গে কথা বলে দেয়া হয়েছে। তারা আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। এলমার রেকর্ডসহ প্রমাণাদি যা আমাদের কাছে ছিল সেগুলো ডিবি পুলিশ নেয়নি।
‘ময়নাতদন্ত রিপোর্টে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমার মেয়েকে ওরা (আসামিরা) শ্বাসরোধে হত্যা করেছে। এই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট সত্য নয়। কারণ আমার মেয়ের শরীরে যেসব আঘাতের চিহ্ন ছিলো সেগুলো রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি। যেদিন এলমার স্বামী বিদেশ থেকে এসেছে ওইদিন সে খুব খুশি ছিল।’
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ‘১০-১৫ দিন আগে আমরা ঢাকায় ডিবি পুলিশের অফিসে গিয়েছিলাম মামলা সংক্রান্ত প্রমাণ দিতে। কিন্তু ডিবির অফিসার মশিউর রহমান আমাদের সঙ্গে খারাপ ও রূঢ় আচরণ করেছেন। আমার স্ত্রী কথা বলতে গেলে তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন ওই কর্মকর্তা। আমার মেয়েই খারাপ আর ছেলে ভালো- এমনটা বলছিলেন তিনি। ডিবি পুলিশের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আমরাই আসামি। আগে থেকে আমরা বলে আসছি, আসামিপক্ষ সম্পদশালী ও প্রভাবশালী। তারা প্রভাব খাটিয়ে পুলিশকে দিয়ে মামলার মিথ্যা চার্জশিট দিয়েছে।
মামলায় যে অভিযোগ
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর দুপুরের পর এলমাকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এলমার মৃত্যুর পর নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেন তার বাবা সাইফুল ইসলাম।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় ইফতেখার আবেদীনকে। এলমার শাশুড়ি শিরিন আমিন ও শ্বশুর মো. আমিননকেও আসামি করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মো. আমিন ইফতেখারের সৎবাবা।
মামলার এজাহারে বাদী বলেন, ‘বিয়ের পর ইফতেখার ও তার বাবা-মা এলমাকে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু তা না মেনে সে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। এ জন্য তাকে নির্যাতন সহ্য করতে হয়।’
সাইফুল ইসলাম ঘটনার পর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়ে পড়া বন্ধ করতে না চাইলে ইফতেখার ও তার পিতা-মাতা মেয়েকে শারীরিক নির্যাতন করে মাথার চুল কেটে দেয় এবং সাংসারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে।’
ডিবির তদন্তে যা উঠে এসেছে
ঘটনার পর মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে বনানী থানা পুলিশ। এরপর দায়িত্ব দেয়া হয় ডিবি গুলশান বিভাগকে। ইতোমধ্যে তারা তদন্ত শেষ করেছে।
ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, জরুরি তলবে ইফতেখার ১১ ডিসেম্বর কানাডা থেকে দেশে ফেরেন। ১৩ ডিসেম্বর রাতে এলমা ও ইফতেখারের মধ্যে ঝগড়া হয়। এলমা ছবির অ্যালবাম ভেঙে তার কাচ দিয়ে হাত-পা কাটার চেষ্টা করেন। তখন ইফতেখার তাকে বেধড়ক মারধর করেন। ওই রাতেই মারধর করায় ইফতেখার এলমার কাছে মাফ চান।
রাতে ইফতেখার জানান, এক সপ্তাহের ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে কানাডায় ফিরে যেতে হবে। তিনি এলমার কাছে তার পাসপোর্ট চাইলে বাদ সাধেন এলমা। ছুটি বাড়িয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেন।
জবাবে ইফতেখার এলমাকে জানান, ছুটি বাড়ানো সম্ভব নয়। আর এই মুহূর্তে তাকে কানাডায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় তাকে বলেন, ইফতেখার কানাডায় চলে গেলে তিনি আর সংসার করবেন না। বাবার বাড়ি চলে যাবেন। কিন্তু রাতে তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেননি ইফতেখার। এক পর্যায়ে তিনি শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। কিছু সময় পর শোবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পরবর্তীতে দরোজা ভেঙে ফ্যানের সঙ্গে এলমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। তাকে উদ্ধার করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করে।