বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কন্যাশিশু নেয়ার বিরোধে হত্যা, সেই মসজিদ এখন খাঁখাঁ

  •    
  • ১৬ এপ্রিল, ২০২২ ১৭:১৩

৬০টি পরিবার নিয়ে সমাজভিত্তিক মসজিদটি কোনো ঝামেলা ছাড়াই চলছিল এতদিন। সেই রাতে সংঘর্ষের পরদিন প্রাণহানির ঘটনায় দু-একজন ছাড়া কেউ নামাজ পড়তে আসতেছে না। এই রমজানে মুসল্লি সংকটে পড়েছে মসজিদটি। এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত আজান দেয়ার সুনির্দিষ্ট লোকও নেই।

নরসিংদীতে রায়পুরা উপজেলার উত্তর বাখরনগর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে আড়ো প্রধানবাড়ির মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজের আগে গিয়ে দেখা যায়, ইমাম মোফাজ্জল হোসেন বারান্দায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে।

পাঁচ বছর বয়সী মেয়েশিশুকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার পর এটি জায়েজ কি না, এ নিয়ে তর্কাতর্কি ও পরে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন একজন।

এ ঘটনায় মামলা করা হলে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর পর থেকে ওই মহল্লায় আতঙ্কে বাড়িছাড়া ১২ পরিবারের মানুষ। ফলে মসজিদে আসা মুসল্লির সংখ্যাও এখন কম।

ইমাম সাহেবের মন খারাপ করার কারণ বোঝা গেল একটু পরেই। ৬০টি পরিবার নিয়ে সমাজভিত্তিক মসজিদটি কোনো ঝামেলা ছাড়াই চলছিল এতদিন। সেই রাতে সংঘর্ষের পরদিন প্রাণহানির ঘটনায় দু-একজন ছাড়া কেউ নামাজ পড়তে আসছে না। এই রমজানে মুসল্লি সংকটে পড়েছে মসজিদটি। এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত আজান দেয়ার সুনির্দিষ্ট লোকও নেই।

জুমার নামাজে মুসল্লি ছিল সবে সাতজন। এদের একজন রেজাউল করিম। বাড়ি যশোর, শ্বশুরবাড়ি রায়পুরার অলিপুর গ্রামে। এখানেই জমি কিনে পরিবার নিয়ে থাকেন। মুদি ও মনোহরি পণ্যের ব্যবসা করেন।

মসজিদটি পাশে হওয়ায় এখানেই নামাজ আদায় করেন তিনি। সেই প্রাণহানির পর মাঝেমধ্যে নিজেই আজান দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘এলাকায় একটি ঘটনা ঘটেছে। এতে মসজিদে আসা বন্ধ করে দিয়েছে সবাই। এটা দুঃখের বিষয়।’

কী হবে পরিবারটির

নিহত লাল চাঁনের চারটি সন্তান। এর মধ্য দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে। সবার ছোটটির বয়স কেবল এক সপ্তাহ।

লাল চাঁনের ভাই কামাল বাদশা জানান, কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন তার ভাই। ঘটনার পাঁচ দিন আগে সিজারে বাচ্চা হয়েছে। তার স্ত্রীর অবস্থাও ভালো না।

‘ছোট একটা বিষয় নিয়ে আমার ভাইটাকে হারাতে হলো। আমরা আইনের আশ্রয় নিয়েছি’- বলেন তিনি।

চার শিশু সন্তানকে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় লালচানের স্ত্রী। ছবি: নিউজবাংলা

কী নিয়ে সংঘর্ষ

ইমাম মোফাজ্জল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটি হচ্ছে মাগরিবের নামাজের সময়। এই মহল্লার এক ব্যক্তি ছোট বাচ্চা নিয়ে আসেন, বাচ্চাটি ছিল মেয়ে। তার বাবা আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিল।

‘দক্ষিণ পাশে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি মেয়েটি নিয়ে প্রথম কথা বলেন। তিনি বলতেছিলেন, মেয়েটিকে কেন ইমামের পেছনে দাঁড় করানো হলো? যদি ইমাম সাহেবের ভুল হয়?’

ইমামের ভাষ্যমতে, এই কথা নিয়ে একপর্যায় দুজনে তর্কে জড়িয়ে যান। তারা শান্ত হলে মাগরিবের নামাজ পড়ানো হয়। তবে বিতর্কের রেশ রয়ে যায়।

নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে হাতাহাতি হয়। তখন অন্য মুসল্লিরা বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা সফল হননি।

প্রত্যক্ষদর্শী ও মসজিদের জমিদাতা ৯০ বছর বয়সী দুলাল মিয়ার বর্ণনাও একই রকম। তিনি বলেন, “নুরুল ইসলাম তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ইমামের পেনে দাঁড়ানো ছিলেন। তখন একই সমাজের আলাউদ্দিন বলে ওঠেন, এই নাবালিকা মেয়েটাকে কেন নিয়ে আসলেন? নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনার সমস্যা কী’ এভাবে দুইজনে তর্কে জড়িয়ে যান।

“নামাজ শেষে মসজিদের ভেতর ঝামেলা শেষ করে দিয়ে বাড়িতে চলে যাই। পরে তারাবির নামাজ পড়তে মসজিদে এসে শুনতে পাই, মাগরিবের নামাজের পর মসজিদের বাইরে গিয়ে আলাউদ্দিনকে মারধর করে নুরুল ইসলাম ও তার ভাতিজারা।”

নিহত লালচান মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

দুলাল মিয়া জানান, সে সময় মুসল্লিরা সকালে এই বিরোধ নিয়ে বসার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বিরোধে জড়ানো দুই পক্ষের কেউ তা মানেনি। রাত ১০টার দিকে আবার আলাউদ্দিন ও নুরুল ইসলামের মধ্য মারামারি হয়। এ সময় লাল চান নামে আলাউদ্দিনের এক ভাগিনা আহত হন। ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি।

মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিহত লাল চাঁনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মামা আলাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেদিন বাড়িতে ইফতার করে মসজিদে নামাজ পড়তে যাই। নামাজের সময় নুরুল ইসলাম তার মেয়েকে নিয়ে মসজিদের ইমামের পেছনে দাঁড়ানোটা আমার কাছে কেমন জানি মনে হলো। তাই তাকে বলছিলাম এক সাইডে দাঁড়াতে।

‘কিন্তু নুরুল ইমামের পেছনে মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে নুরুলের বড় ইদ্রিস ভাইকে বলি, কাজটা ঠিক করে নাই। যদি ইমামের ভুল হতো? এতে নুরুল ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে প্রথমে গালি দেয়। পরে তার ভাতিজা ও নুরুল মিলে আমাকে মারধর করে।

‘ওই রাতেই ভাগিনা লাল চাঁন আমাকে দেখতে বাড়িতে আসে। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই নুরুল ও তার লোকজন মিলে তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে। পরে সে হাসপাতালে মারা যায়।’

আসামিরা লাপাত্তা, বাড়িঘর পরিত্যক্ত

লাল চাঁন হত্যা মামলার আসামি নুরুল ইসলামসহ ১২ জনের বাড়িতে গিয়ে নারী-পুরুষ কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাড়িগুলো দেখে মনে হয় ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।

কয়েকজন পথচারীর তথ্য মিলে গেল এই ধারণার সঙ্গে। তারা জানান, নিহত লাল চাঁনের মামা আলাউদ্দিন ও তার লোকজনেরা ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে আসবাবসহ মালামাল নিয়ে গেছে, এমনকি টিউবওয়েলগুলোও বাদ যায়নি।

তবে লাল চাঁনের ভাই কামাল বাদশা ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, ‘লাল চাঁন মারা যাওয়ার পর ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করা হয়। এরা সবাই বাড়ির মালসামাল নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

রায়পুরা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) গোবিন্দ সরকার নিউজবাংলাকে জানান, লাল চাঁন হত্যা মামলার ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠনো হয়েছে। এ ছাড়া জেলা পুলিশের সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা খোঁজ খবর নিচ্ছেন।

নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দুপক্ষের মধ্যে আগের কোনো বিরোধ ছিল না। মসজিদে মেয়ে নেয়ার জেরেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

‘লাল চাঁন হত্যা ঘটনায় তার মামা আলাউদ্দিন নুরুল ইসলামসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর মধ্যে জসিম উদ্দিন নামে একজন আটক করেছে। বাকি আসামিরা পলাতক। সবাইকে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ তৎপর রয়েছে। এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর