নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে শিশু তাসকিয়া আক্তার জান্নাত হত্যায় জড়িত হিসেবে যাদের নাম উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দেরও রয়েছে নানা অভিযোগ। বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে মামলাও আছে এসব তরুণের নামে।
গুলি ও আঘাত করে গত বুধবার বিকেলে হত্যা করা হয় বেগমগঞ্জ উপজেলার পূর্ব হাজিপুর গ্রামের চার বছর বয়সী তাসকিয়াকে। হামলায় ডান চোখ হারান শিশুটির বাবা আবু জাহের।
পরদিন তাসকিয়ার খালু হুমায়ুন কবির ১৭ জনের নামে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের ২৪ বছর বয়সী মামুন উদ্দিন রিমনকে। এই তরুণের বিরুদ্ধে হত্যা, মাদকসহ নয়টি মামলা রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রিমনের নেতৃত্বে এই এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। এই বাহিনীর সদস্যরা মাদক কারবারে জড়িত। একইসঙ্গে প্রত্যেকে মাদকসেবী। কোনো কারণ ছাড়াই লোকজনকে মারধর, চাঁদাবাজি ও নারীদের উত্ত্যক্ত করা থেকে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা ওরা করে না। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতেও দেখা গেছে তাদের।
রিমনসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের কয়েকজনকে পুলিশ একাধিক বার গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বেরিয়ে এসে ওরা আবারও একই ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়।
বেগমগঞ্জ মডেল থানার তথ্য অনুযায়ী, চাঁদাবাজি, মাদক, হত্যা, মারামারি ও অস্ত্র আইনে রিমনের নামে নয়টি মামলা রয়েছে।
তাসকিয়া হত্যা মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে মহিন উদ্দিনের নামে সাতটি ও মো. রহিমের নামে দুইটি এবং মো. সুজন, মো. শাকিল, হেদায়েত উল্ল্যাহ সাগর ও মো. সম্রাটের নামে একটি করে মামলা আছে। এরা সবাই রিমনের দলের সদস্য।
থানা সূত্র আরও জানায়, ২০১৯ সালে হাজিপুর ইউনিয়নের কালামিয়ার পুলে শাহাদাত ও ২০২০ সালে কুতুবপুর ইউনিয়নে বিয়ের আসরে মাহফুজ নামের আরেক যুবককে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ দুটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ রিমন, মহিন ও রহিমকে গ্রেপ্তার করে।
এর আগে ২০১৮ সালে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ বাজার থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালককে অপহরণ মামলায় ছয় মাস জেলে ছিল এই তিন তরুণ।
হাজিপুর গ্রামের তাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এরা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী। এরা বাজারের বিভিন্ন দোকানের সাটার গুলি করে ও কুপিয়ে নষ্ট করেছে। এরা আমার চাচাতো ভাইয়ের অবুঝ শিশুকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা সরকার ও প্রশাসনের কাছে বিচার দাবি করছি।’
পল্লি চিকিৎসক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘এই সন্ত্রাসীরা এসে আমাদের কাছে চাঁদা দাবি করে। না দিলেই হামলা করে। আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি। কোনো রোগী আসতে চায় না, দোকান বন্ধ করে দিতে হয়।’
রিমনের অস্ত্রের উৎস
বেগমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, গত কয়েক বছর এই উপজেলায় সম্রাট বাহিনী ও খালাসি সুমন বাহিনীর আধিপত্য ছিল। সম্রাট ও সুমনকে বিভিন্ন সময় সাবেক পৌর মেয়র আকতার হোসেন ফয়সালের সঙ্গে দেখা যেত। গত পৌরসভা নির্বাচনে ফয়সাল পরাজিত হলে সম্রাট ইতালি চলে যান এবং সুমনকে পুলিশ কারাগারে পাঠায়।
ওই দুই বাহিনীর পর এলাকায় শিহাব বাহিনীর উত্থান ঘটে। শিহাব নোয়াখালী-৩ আসনের সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ কিরণ, তার ছেলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য জিহান আল রশিদ ও চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র খালেদ সাইফুল্লাহর হয়ে কাজ করে। শিহাবের সেকেন্ড ইন কমান্ড পিয়াসের দুই সহযোগী স্বাধীন ও নাঈম রিমনকে অস্ত্র ও মাদক সরবরাহ করে।
তাদের কাছ থেকে সরবরাহ পাওয়া অস্ত্র দিয়েই তাসকিয়া ও তার বাবার ওপর হামলা চালানো হয়।
কী হয়েছিল সেদিন
আবু জাহের সৌদি আরব প্রবাসী। দুই মাস আগে তিনি দেশে ফেরেন। জন্মের পর প্রথমবারের মতো বাবাকে কাছে পায় শিশু তাসকিয়া।
বাবার কোলে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় তাসকিয়া আক্তার জান্নাত। ছবি: সংগৃহীত
বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাড়ির পাশে ডোবায় বাবার সঙ্গে মাছ ধরে তাসকিয়া। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বাবার কাছে বায়না ধরে চকলেট আর চিপস কিনে দেয়ার।
এরপর বাবার সঙ্গে পাশের দোকানে গেলে সেখানে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয় বাবা ও মেয়ে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে শিশুটির মাথা, মুখসহ পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দোকানি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘রিমন, মহিন, রহিম, আকবর, সুজনসহ ১৫ থেকে ২০ জন সন্ত্রাসী আমার দোকানে আসে। তারা আবু জাহের ও তার মেয়েকে লক্ষ্য করে প্রথমে একটি গুলি করে।
‘গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সন্ত্রাসীরা শিশুকন্যাকে ইট দিয়ে আঘাত করে। বাবা-মেয়ে দোকান থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে রিমন আরও দুইটি গুলি করে। এতে লুটিয়ে পড়ে বাবা-মেয়ে।’
বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর জাহিদুল হক রনি জানান, আহত বাবা-মেয়েকে উদ্ধার করে প্রথমে ২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে রাত ৮টার দিকে কুমিল্লায় শিশু তাসকিয়ার মৃত্যু হয়।
কী নিয়ে বিরোধ
জাহেরের আত্মীয় ফিরোজ আলম জানান, তার ভাই খোরশেদ আলম রিমনের চাচা বাদশার কাছে নিজের জমির মাটি বিক্রি করেছিলেন। ওই জমি থেকে বাদশার ছয় ফুট মাটি কাটার কথা ছিল। তবে তারা আরও বেশি মাটি কাটতে শুরু করলে তার জমির মাটি ধসে যেতে শুরু করে। এতে তিনি বাদশাকে বাধা দেন।
বিষয়টি মীমাংসার জন্য ৮ এপ্রিল ফিরোজের বাসায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনায় বসেন বাদশা। সেখানে রিমন, মহিন, সুজন, রহিম, আকবরসহ বেশ কয়েকজন এসে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় ও গুলি ছোড়ে। বাদশা নিজেও এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে শরিক হয়।
গুলিতে নিহত শিশু তাসকিয়ার বাবা আবু জাহের। ছবি: নিউজবাংলা
ফিরোজ বলেন, ‘তারা আমার অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের পেটে লাথি মারে। পরদিন আমি আমার মেয়ে ও মেয়ে জামাইকে নিয়ে থানায় অভিযোগ জানালে পুলিশ আমাদেরই তাদেরকে ধরে দিতে বলে। থানায় জানানোর কারণে সন্ত্রাসীরা পরদিন আবার হামলা করে। আমরা ৯৯৯ কল দিয়ে পুলিশ ডাকায় তারা পালিয়ে যায়। পুলিশ চলে গেলে ওরা আবার আসে।
‘জাহের আমার প্রতিবেশী ও আত্মীয়। সে রিমনদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। এটা নিয়েই জাহেরের প্রতি রিমনের ক্ষোভ তৈরি হয়।’
মামলার অগ্রগতি
বেগমগঞ্জ থানার ওসি রনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অপরাধীদের গ্রেপ্তারে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। আসামিদের মধ্যে এনাম হোসেন স্বপন, জসীমউদ্দিন বাবর ও একজন কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার তাদের প্রত্যেকের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।’
আদালত পুলিশের পরিদর্শক শাহ আলম জানান, আগামী রোববার আসামিদের রিমান্ড শুনানি হতে পারে।
তবে মূল আসামিদের গ্রেপ্তার না করায় ক্ষোভ জানান তাসকিয়ার বাবা জাহের।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ এখনও চিহ্নিত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তারা আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু আমি কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। আমি প্রশাসন ও পুলিশের কাছে আকুল আবেদন জানাই যেন আগামী এক দিনের মধ্যে এদের আইনের আওতায় আনা হয়।’
তাসকিয়ার মামাতো ভাই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পুলিশের অ্যাকশন কিছুই দেখতেছি না। আসামি না ধরা পর্যন্ত প্রশাসনের ওপর কোনো আস্থা পাইতেছি না। মামলায় আমি যেসব আসামির কথা বলছি তা উল্টা হয়ে গেছে। আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না।
‘পুলিশ সকাল-সন্ধ্যা আসে। কিন্তু তারা নাকি কাউকেই খুঁজে পায় না। ওসি সাহেব ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের ধরার আশ্বাস দিছিলেন। সেই সময় পার হয়ে গেছে। আমি ভয়ে আছি কখন আবার তারা আমার ওপর হামলা করে। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি।’
রিমনের বিষয়ে ওসি জানান, পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীও বিভিন্নভাবে তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালাচ্ছে।