পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণের দাবিতে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণের ঘটনায় এখনও কূল-কিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে এই ঘটনায় বছর বিশেক আগে আলোচিত সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান বাহিনীর সদস্যদের সন্দেহ করছে গোয়েন্দা বিভাগ। পাশাপাশি একজন ঠিকাদার ও দুজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে রাখা হয়েছে নজরদারিতে।
২০০৪ সালের ২৬ জুন র্যাবের অভিযানে ‘ক্রস ফায়ারে’ পিচ্চি হান্নান নামে পরিচিতি পাওয়া আবদুল হান্নান নিহত হলেও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের অনেকেই এখনও রয়ে গেছে।
গলাচিপার বাদুরা বাজারের ব্রিজ থেকে শাখারিয়া মোড়ের মধ্যবর্তী কোনো এক স্থান থেকে গত ১১ এপ্রিল রাতে ব্যবসায়ী শিবু লাল দাস ও গাড়িচালক মিরাজ হোসেনকে অপহরণ করা হয়।
তাকে ছেড়ে দিতে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শহরের সবুজবাগ এলাকার এসপি কমপ্লেক্সের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় শিবুর ছেলে অপহরণ মামলা করেন। ধনাঢ্য এই ব্যবসায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
কেন শিবুকে অপহরণ করা হলো, এ ঘটনার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তা এখনও জানতে পারেনি পুলিশ।
কেন পিচ্চি হান্নানের দলকে সন্দেহ
শিবু ও মিরাজকে যে বস্তায় পাওয়া গেছে সেই বস্তায় একটি দোকানের স্টিকার লাগানো ছিল। যে কমপ্লেক্সের আন্ডারগ্রাউন্ডে তাদের পাওয়া গেছে দোকানটিও ওই কমপ্লেক্সের দোতলায় অবস্থিত।
ওই দোকানের মালিক একসময় ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের হয়ে কাজ করতেন বলে তথ্য দিয়েছেন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে ঢাকার একাধিক থানায় মামলা রয়েছে।
সেই কর্মকর্তা জানান, পিচ্চি হান্নানের হয়ে কাজ করতে গিয়ে ওই ব্যক্তির একটি পা গুলিবিদ্ধ হলে তা কেটে ফেলা হয়। পরে প্লাস্টিক সার্জারি করে কৃত্রিম পা লাগিয়ে তাকে চলাফেলা করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এ অপহরণের ঘটনায় ওই দোকানের মালিকের সঙ্গে পিচ্চি হান্নানের দলের বেশ কয়েকজন সদস্য ও পটুয়াখালী শহরের একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারেন।’
নজরদারিতে ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতাও
সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, এই অপহরণের ঘটনায় পটুয়াখালীর একজন প্রভাবশালী ঠিকাদার, ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতা পরোক্ষভাবে জড়িত বলেও অনেকের মুখে মুখে শুনতে পাচ্ছেন তারা। তাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
তবে সেই ঠিকাদার ও ছাত্রলীগ নেতা কারা- সেটি স্পষ্ট করেননি তিনি।
গত ১২ তারিখ রাত সাড়ে ১১টার দিকে শিবুকে উদ্ধারের পরে পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে যে বা যারা জড়িত সবাইকে আমরা নজরদারিতে রেখেছি। কেউ ছাড় পাবে না।’
মামলার সবশেষ খবর জানতে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ভুক্তভোগীদের জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছি, এটাই বড় পাওয়া। তারপর মামলা হয়েছে। পুরো ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টায় আছি।’
সাদা রঙের সেই মাইক্রোবাসের খোঁজে
ওই মহাসড়কের একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে গোয়েন্দা সদস্যরা সেই সাদা রঙের মাইক্রোবাসটি শনাক্তের চেষ্টায় আছে। শিবুকে যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেখানেও একটি সাদা রঙের মাইক্রোর সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তবে গাড়িটি শিবুর গাড়ির পেছনে থাকা সেই মাইক্রো কি না তা যাচাই করছেন গোয়েন্দা সদস্যরা।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার দিন রাত ১টা ৫৯ মিনিটের শিবুর ব্যবহৃত ফোন দিয়ে তার স্ত্রীর ফোনে কথা বলার সময় সেই নম্বরের আশপাশে বেশ কয়েকটি ফোন নম্বরকেও পর্যবেক্ষণ করছে পুলিশের একাধিক দল।
অপহরণের বর্ণনা স্বজনের
গত দুই দিন নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় ব্যবসায়ী শিবুর পরিবারের। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও দিয়েছেন নানা তথ্য।
শিবুর পরিবারের এক সদস্য বলেন, ‘ঘটনার দিন ব্যবসায়ী তার ব্যবহৃত প্রাডো গাড়িতে গলাচিপা উপজেলার বাদুরা বাজারের ব্রিজ পার হয়ে শাখারিয়া ইউনিয়নের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে মাঝামাঝি স্থানে সড়কের ওপর একটি ট্রলি আড়াআড়ি করে রাখা হয়।
‘শিবুর গাড়ি থামলে মুহূর্তের মধ্যে মুখে মাস্ক পরা আনুমানিক ১০ থেকে ১২ জন লোক দরজা খুলে গাড়িতে ওঠেন। তারা শিবু ও গাড়িচালক মিরাজকে মারধর করে তাদের দুজনের মোবাইল কেড়ে নেন।
‘পরে তাদের মধ্য থেকে ছয়জন লোক শিবুর গাড়িতে থাকেন। অন্যরা একটি সাদা মাইক্রোতে উঠে বসেন। এরপর গাড়িটি শাখারিয়া মোড় পার হয়ে পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের আমতলীর দিকে যায়।’
শিবু শুনেছিলেন বস আর গাজীপুর শব্দ দুটি
শিবুর সেই স্বজন জানান, গাড়ি চলতে থাকলে একটি খেলনা পিস্তল এই ব্যবসায়ীর মাথায় ঠেকালে ধাক্কাধাক্কিতে সেটি ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শিবু ও মিরাজের হাত-পা বেঁধে গাড়িতে শুইয়ে রাখা হয়।
কিছুক্ষণ পর আমতলী উপজেলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের আগে তাদের ব্যবহৃত গাড়ি থেকে নামিয়ে পেছনের সাদা রঙের মাইক্রোতে বসিয়ে তাদের চোখ বেঁধে রাখা হয়।
তিনি বলেন, “ওই সড়কের গাজীপুর স্টেশন এলাকা থেকে আঞ্চলিক সড়কে প্রবেশ করে কয়েক কিলোমিটার দূরে যায়। এ সময় দুষ্কৃতকারীরা বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলেছে, তখন শুধু ‘বস’ ও ‘গাজীপুর স্টেশন’ কথাটি শুনতে পেরেছিলেন শিবু।”
একপর্যায়ে রাত ১টা ৫৯ মিনিটের সময় শিবুর ফোন দিয়ে তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়।
অপহরণের সময় থেকে পরের দিন রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত অপহরণকারীরা তাদের পানি ছাড়া কিছুই খেতে দেননি বলেও জানান তিনি।
রাতে কোন সময় তাদের বস্তায় ভরেছে তার সঠিক সময় বলতে পারছেন না শিবু ও মিরাজ। তবে তাদের উদ্ধারের অন্তত ১৫ থেকে ২০ মিনিট আগে গাড়ি থেকে নামিয়ে কোনো এক জায়গায় রাখা হয়েছিল কয়েক মিনিটের জন্য। তখন একজনকে কোক আনতে বলা হয়েছে বলেও শুনতে পেরেছেন শিবু।
শিবুর সেই স্বজন বলেন, ‘এ ছাড়া অনেক সময় বস্তাবন্দি অবস্থায় গাড়িতে ছিল সেটি নিশ্চিত হয়েছেন চলন্ত গাড়ির শব্দ শুনে। আর বাকি সময় নির্জন স্থানে রাখা হয়েছে বলে তার ধারণা, কারণ তখন আশপাশে কোনো শব্দ শুনতে পাননি।
‘২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ চাওয়ার সময় শিবুর স্ত্রী তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, টাকা যা লাগে পাওয়া যাবে, কিন্তু তার জন্য শিবুকে জীবিত ফেরত দিতে হবে। কারণ শিবু ছাড়া এত মোটা অঙ্কের টাকা দ্বিতীয় কেউ দিতে পারবে না। প্রয়োজনে ভারত থেকেও টাকা এনে দেয়া যাবে। কোনো সমস্যা হবে না।’
পরিবারের ধারণা, টাকা দেয়া হবে, এটি নিশ্চিত করার কারণেই অপহরণকারীরা শিবুকে জীবিত রেখেছেন।