পুঁজিবাজার নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে নানা মতপার্থক্য সামনে আসার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি বৈঠক হলেও দ্বিতীয় প্রতিশ্রুত সেই বৈঠক আর হয়নি।
অথচ গত ৭ ডিসেম্বরের বৈঠক শেষে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা ছিল, ‘চলতি মাসে অথবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে আবার বৈঠক হবে এবং ওই বৈঠকে পুঁজিবাজারের জন্য দৃশ্যমান কিছু দেখা যাবে।’
আরও পড়ুন: আলোচনা ‘ইতিবাচক’, পরের বৈঠকে ‘দৃশ্যমান সিদ্ধান্ত’
সে ঘোষণার পর ডিসেম্বর পেরিয়ে জানুয়ারি, এরপর ফেব্রুয়ারি শেষে মার্চও শেষ হলো। চলে গেল এপ্রিলের অর্ধেকটাও। ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে বৈঠকের কথা যে কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছিলেন, তিনি এখন বলছেন, এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত ওপরের মহলের বিষয়।
গত সেপ্টেম্বরে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি সামনে আসার পর পুঁজিবাজারে যে ছন্দপতন দেখা দিয়েছিল, সেটি এখন পরিণত হয়েছে ধসে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর দিন থেকে বিশ্বের প্রায় সব পুঁজিবাজারেই ধস দেখা দিলেও পরে অনেকগুলো ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজার পড়ছে তো পড়ছে।
টানা দরপতনের মধ্যে বিএসইসি বাজারে তারল্য বাড়াতে নানা চেষ্টা করছে, কিন্তু তার প্রভাব পড়ছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই; বরং লেনদেন তলানিতে নেমে আসার কারণে বিনিয়োগকারীরা লোকসান দিয়েও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না।
বিনিয়োগ খরার পেছনে অন্যতম কারণ, ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা নির্ধারণের পদ্ধতি পরিবর্তন না হওয়া, বন্ডের বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমার মধ্যে রাখা।
এই বিষয়গুলো নিয়েই হয়েছিল ৭ ডিসেম্বরের সেই বৈঠক।
বৈঠক শেষে যা বলা হয়েছিল
বৈঠক শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও শেয়ারবাজার কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকি কমিটির আহ্বায়ক মফিজ উদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যেসব আলোচনা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে কথা হয়েছে, তবে যেসব বিষয় নিয়ে মতভেদ, সেগুলো নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে আরও একটি বৈঠক করতে হবে। সেই বৈঠকের পরেই ‘দৃশ্যমান’ কিছু দেখা যাবে।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আলোচিত সেই বৈঠক হয়। ছবি: নিউজবাংলা
পরের বৈঠক কবে হবে, সেটিও উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘সেটি চলতি মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২১ অথবা আগামী মাসের জানুয়ারি, ২০২২ এর প্রথম সপ্তাহে হবে।’
এক বৈঠকে সব মতভেদ মেটানো কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ সময় বিরতির পর আমাদের মধ্যে এই বৈঠক হয়েছে। আমাদের আলোচনায় তথ্য-উপাত্তের বেশ কিছু ঘাটতি ছিল, যা আলোচনায় উঠে এসেছে। এ কারণে আরও একটি বৈঠক করতে হবে।’
পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট গণনা পদ্ধতি আর বন্ডে বিনিয়োগ এই সীমার বাইরে থাকবে কি না, এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো খুবই সেনসিটিভ ইস্যু। এ ব্যাপারে এখনই কোনো কথা বলতে চাইছি না। এর জন্য আপনাদের পরবর্তী বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
মফিজউদ্দিন এখন যা বলছেন
‘জানুয়ারি পেরিয়ে এপ্রিল শেষ হতে চলল। কবে বসছেন আপনারা?’
এমন প্রশ্নে মফিজউদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হ্যাঁ আরও একটি বৈঠক করার পর সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ছিল, কিন্তু সেই বৈঠকটি এখনও হয়নি।’
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে বৈঠকের আলোচনা থেকে যে ধরনের সিদ্ধান্ত পাওয়ার কথা বা যে ধরনের সিদ্ধান্তের দিকে পুঁজিবাজার তাকিয়ে, তার সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য এই কমিটি পারফেক্ট নয়। হাই লেভেল ছাড়া এ ধরনের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার আমরা রাখি না।’
এখানে হাইলেভেল বলতে এই কর্মকর্তা অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে বুঝিয়েছেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত দেয়ার বৈঠকটি হয়তো হয়নি, তবে অর্থ মন্ত্রণালয় বসে নেই। সম্প্রতি স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে এ নিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ আলোচনা হয়েছে। এখন হাই লেভেল বৈঠক হলে পুঁজিবাজার উন্নয়নে কী দৃশ্যমান হয়, সেটি জানা যাবে।’
সে বৈঠকটি কবে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটি এখনও ঠিক হয়নি। হলে জানতে পারবেন।’
বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ে যে বৈঠকটি হয়েছিল, সেটি ছিল পুঁজিবাজার উন্নয়নে ২০১৯ সালে সর্বপক্ষীয় অংশীজনদের সর্বসম্মতভাবে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
‘ওই বৈঠকে আগের সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা হয়েছে। সেখানে বিএসইসি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতভিন্নতার কোনো এজেন্ডা ছিল না। বিক্ষিপ্তভাবে এ ইস্যুটি আলোচনায় উঠে থাকতে পারে।’
পরবর্তী বৈঠকটি কবে হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার তথ্য আমার কাছে নেই।’
কোন পরিপ্রেক্ষিতে সেই বৈঠক
২০১৯ সালে শেষবার যখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পুঁজিবাজার নিয়ে একাধিক সংস্থার বৈঠক হয়, তখন বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে একাধিক প্রস্তাব আসে। এর মধ্যে ছিল পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিশেষ তহবিল গঠন, বন্ডে বিনিয়োগের সুবিধা দেয়া এবং পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিশেষ তহবিলের বিনিয়োগ পুঁজিবাজার এক্সপোজারের বাইরে রাখা।
এবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলোর পুঞ্জিভূত লোকসান থাকলেও কোনো বছরে মুনাফা করলে লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ দেয়ার পক্ষে প্রস্তাব দেয়া হয়।
পুঁজিবাজারের কোম্পানিগুলোর অবণ্টিত মুনাফা দিয়ে গঠন করা স্থিতিশীলতা তহবিলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানি থেকে টাকা আসতে যেন বাধা দেয়া না হয়, এই বিষয়টিও নিশ্চিত হতে চাইছে বিএসইসি, তবে বিএসইসির প্রধান চাওয়া পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা শেয়ারের বাজার মূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা এবং বন্ডে বিনিয়োগকে ব্যাংকের এই বিনিয়োগসীমার বাইরে রাখা।
এসব বিষয় নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বিএসইসির বৈঠক হয়। সেই বৈঠক শেষে কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ জানান, তাদের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। এই দুটি বিষয়ে দুই পক্ষ নীতিগতভাবে একমতও হয়েছে, তবে দাপ্তরিক কিছু কাজ শেষে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
তার এই বক্তব্যের পর পুঁজিবাজারে ব্যাপক উত্থান হয়। বৈঠকের পরের দিন সূচক বাড়ে ১৪৩ পয়েন্ট, কিন্তু সেই রাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিজ্ঞপ্তিতে তৈরি হয় নতুন উদ্বেগ।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বিএসইসির সঙ্গে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএসইসি কমিশনারের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন এসেছে, সেগুলো সঠিক নয়।
এই বিজ্ঞপ্তির পর আতঙ্ক এতটাই জেঁকে বসে যে, পরদিন লেনদেনের দুই মিনিটেই সূচক পড়ে যায় ৮৪ পয়েন্ট। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকার এই খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পর তৈরি হয় উল্টো পরিস্থিতি। দিন শেষে সূচক বাড়ে ৮৯ পয়েন্ট।
এরপর আরও দুই দিন সূচক বাড়ে অল্প করে। সব মিলিয়ে চার কর্মদিবসে সূচক বাড়ে ২৭৫ পয়েন্ট। বৈঠকের দিন আরও ৭০ পয়েন্ট বাড়ায় টানা ৫ দিনে বাড়ে ৩৪৫ পয়েন্ট, তবে এই বৈঠকে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসার কারণে পরদিন থেকে আবার পতনের ধারায় যায় পুঁজিবাজার।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকের বর্তমান অবস্থান সেই বৈঠকের দিনের চেয়ে ৪৬৪ পয়েন্ট কম।