রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুর রহমান ওরফে আব্দুল করিম ওরফে শফিকুল ইসলামকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের আমলগ্রহণকারী আদালত-২-এ শুক্রবার বিকেলে শফিকুরকে তোলা হলে জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. সাদ্দাম হোসেন তাকে কারাগারে পাঠান।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন আদালত পরিদর্শক মো. আবুবকর সিদ্দিক।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে বৃহস্পতিবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
বাহিনীটি জানায়, নাম পাল্টে নরসিংদীর প্রত্যন্ত একটি গ্রামের মাদ্রাসায় লুকিয়ে ছিলেন মুফতি শফিকুর।
শফিকুর ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলারও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
রাজধানীতে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে শুক্রবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, শফিকুর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় ছয়টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
র্যাব জানায়, শফিকুর ভৈরবে নিজ গ্রাম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৭৫-এ চকবাজারের একটি মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত হেদায়ায় পড়াশোনা করেন। হেদায়া পাস করার পর ১৯৮৩ সালে ভারতে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দাওরায়ে হাদিস পাস করে বাংলাদেশে ফেরত আসেন।
১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে পড়তে যান। এরপর ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে চলে যান এবং তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
১৯৮৯ সালের শেষ দিকে দেশে ফেরেন তিনি। এরপর ঢাকার খিলগাঁওয়ের একটি মাদ্রাসায় পার্টটাইম শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউনে পড়াশোনা করার সময় মুফতি হান্নানও সেখানে পড়াশোনা করতে গেলে তার সঙ্গে পরিচয় হয়।
পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে গেলে জঙ্গি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদের’ সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। আফগানিস্তান থেকে দেশে এসে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা করেন।
১৯৯০ সালে সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং দাওয়াতের কাজ শুরু করেন শফিকুর। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ‘হরকাতুল জিহাদ (বি)’-এর প্রচার সম্পাদক ছিলেন।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হরকাতুল জিহাদের আমির ছিলেন শফিকুর। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি হরকাতুল জিহাদের শূরা সদস্য ছিলেন।
র্যাব জানায়, ২০০১ সালে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর থানাধীন বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত এবং কমপক্ষে শতাধিক লোক আহতের ঘটনায় তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।
২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে থেকে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নাম পাল্টে ২০০৮ থেকে নরসিংদীর একটি মাদ্রাসায় ছিলেন তিনি।
রমনায় বোমা হামলা মামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন ও অনেকে আহত হন। এ ঘটনায় থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করে। দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতে শেষ হয়।
২০১৪ সালের ২৩ জুন বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন। রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ আটজনের ফাঁসি ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেয় আদালত।
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুর।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন দলটির নেতা আইভি রহমানসহ ২৪ জন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ অনেক নেতা অল্পের জন্য বেঁচে যান।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ রায় দেয় বিচারিক আদালত। শফিকুর এ হামলা মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।