সন্ত্রাসীরা যখন কোলে থাকা মেয়েকে লক্ষ্য করে হামলা করছে, তখন তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অনুনয়-বিনয়ের কমতি রাখেননি বাবা আবু জাহের। কিন্তু তাদের মন গলেনি। মেয়েটিকে কাছ থেকে গুলি করা ছাড়াও মাথায় আঘাত করা হয়েছে ইট দিয়ে।
দুই দিন আগে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নির্মম এ ঘটনাটি তোলপাড় ফেলেছে দেশজুড়ে। মেয়ে হারানো বাবা গুলিতে হারিয়েছেন চোখ। কিন্তু সন্তান চলে যাওয়ার বেদনার কাছে এটা যেন কিছুই নয় তার কাছে।
বছর চারেক আগে জন্ম মেয়েটার। বাবা তখন সৌদি আরবে। মেয়ে বড় হয়, মনে জমতে থাকে বাবাকে দেখতে না পারার আক্ষেপ। একপর্যায়ে মেয়েটা কথা বলতে শেখে, বাবাকে দেখার আবদার করে। দেশে ফেরার আহ্বান আর উপেক্ষা করতে পারেননি জাহের। আর সেটিই হলো কাল।
নিজের কোলে গুলিবিদ্ধ কন্যাশিশু, একজন পিতার জীবনে এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে- বলেছিলেন জাহের। তিনি বলেন, ‘আমার হুর, আমার হুর। ওরা আমার হুরের প্রতি এত নিষ্ঠুর হলো কীভাবে? আমার মেয়েটাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিল কেন?’
মেয়েটাকে রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বলেন, ‘আমি আমার কলিজার টুকরাকে ভিক্ষা চেয়েছি, তারা দেয়নি।’
ঘটনাটি ঘটে বুধবার বিকেলে। পরদিন হয় মামলা, এতে উল্লেখ ছিল ১৭ জনের নাম, যাদের মধ্য থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
তবে যারা সরাসরি খুনে জড়িত, তারা ধরা পড়েনি জানিয়ে আবু জাহের বলেন, ‘দুই দিন পার হয়ে যাওয়ার পরও কেন পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না, বুঝতেছি না।’
এই হত্যায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল আগেও। জাহের বলেন, ‘এই সন্ত্রাসীদের কারণে এলাকার ২০০ পরিবার বসবাস করতে পারছে না।’
বুধবার রাতে বেগমগঞ্জের পূর্ব হাজীপুরে বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় চার বছরের তাসকিয়া। গুলিবিদ্ধ হয় তার বাবা। তিনি দেশের বাইরে থাকেন।
তাসকিয়ার অনুরোধেই সৌদি আরব থেকে দুই মাস আগে দেশে ফেরেন জাহের। জন্মের পর এই প্রথম বাবাকে কাছে পায় শিশুটি।
বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাড়ির পাশে ডোবায় বাবার সঙ্গে মাছ ধরে তাসকিয়া। বেলা সাড়ে ৩টায় বাবার কাছে বায়না ধরে চকোলেট আর চিপস কিনে দেয়ার।
বাবার সঙ্গে পাশের দোকানে চকোলেট কিনতে গিয়ে নিহত হয় সে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে তার মাথা, মুখসহ পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দোকানি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দুর্গাপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের রিমন, মহিন, রহিম, আকবর, সুজনসহ ১৫-২০ সন্ত্রাসী আমার দোকানে আসে। তারা আবু জাহের ও তার মেয়েকে লক্ষ্য করে প্রথম এক রাউন্ড গুলি করে।
‘গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে শিশুকন্যাকে ইট দিয়ে আঘাত করে। একপর্যায়ে তারা দোকান থেকে বের হয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় পেছন থেকে রিমন পুনরায় আরও দুই রাউন্ড গুলি করে। এতে লুটিয়ে পড়ে বাবা-মেয়ে।’
তাসকিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তানের পোশাক বুকে নিয়ে কাঁদছেন মা জেসমিন আক্তার। সাংবাদিক পরিচয় শুনে প্রশ্ন করেন, তার মেয়ে কেন মারা গেল? মেয়েকে হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার দাবি করেন তিনি।
এদিকে শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে তাসকিয়ার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার চোখ থেকে রক্ত পড়ায় স্ত্রী ও স্বজনরা তাকে ঢাকা নিয়ে যান।
কী নিয়ে বিরোধ
শিশুর দাদা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমাদের বাড়ির খোরশেদ আলম নামে এক ব্যক্তি জমির মাটি বিক্রি করে রিমনের চাচা বাদশার কাছে। বাদশা ওই জায়গা থেকে ছয় ফুট মাটি কাটে। এরপর আরও মাটি কাটতে গেলে আমাদের বাড়ির লোকজন তাকে বাধা দেয়। কারণ এভাবে মাটি কাটতে গেলে তাদের জায়গা ভেঙে পড়বে।
‘একপর্যায়ে মাটি কাটতে বাধা দেওয়ার খবর পেয়ে সন্ত্রাসী রিমন ও তার সহযোগী রহিম, মহিন, সুজনসহ আরও কয়েকজন গত দুদিন একাধিকবার আমাদের বাড়িতে এসে গোলাগুলি করে এবং আমার অন্তঃসত্ত্বা ভাগ্নিকে পেটে লাথি দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব সন্ত্রাসীর শুধু তাসকিয়াকে হত্যা করেনি। এর আগেও তারা এলাকায় চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ছিনতাইসহ বহু সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে। তাদের ভয়ে এলাকার মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত থাকে।’