করোনা মহামারির মধ্যে গত বছরের আগস্টে মর্জিনা বেগম জানতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। অভাবের সংসারে নতুন অতিথি আসার খবরটা মোটেই সুখবর হয়ে আসেনি। দুই সন্তানের মা মর্জিনা ও তার স্বামী ভ্রুণ নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেন।
গর্ভধারণের তিন মাসের মাথায় স্থানীয় এক ডাক্তারের সহকারীর পরামর্শে ‘সন্তান নষ্ট’ করার ওষুধ খান তিনি। এতে ভ্রূণ নষ্ট হলেও মর্জিনার জরায়ু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
করোনাকালে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন অনেক নারী। তাদের একটি অংশ গর্ভপাত করাতে গিয়ে জীবন শঙ্কায়ও পড়েন। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী না পাওয়াকে দায়ী করেছেন স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা।
২০২০ সালের মার্চ থেকে পুরো লকডাউনের সময় পরিবার পরিকল্পনা সেবা ব্যাহত হয়। এ সময় পরিবার পরিকল্পনা সেন্টারগুলো বন্ধ ছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর কোনো ঘাটতি না থাকলেও বিতরণব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে ২০২১ সালের জুন থেকে আগস্টের মধ্যে সেখানে অর্ধশতাধিক নারীর গর্ভপাত হয়েছে। এটা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অতিরিক্ত রক্তপাত, সংক্রমণ, অসম্পূর্ণ গর্ভপাত এবং গর্ভপাত-পরবর্তী জটিলতার মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হন।
শঙ্করকাটি গ্রামের বাসিন্দা ২০ বছর বয়সী নাজমা বেগম বলেন, করোনার মধ্যে সরকারি বড়ি (জন্মবিরতিকরণ পিল) পাননি। কিনে ইনজেকশন দেয়ার চেষ্টা করেও সফল হননি।
উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা সহকারী মনিরা জামিলা বলেন, ‘সত্যি বলতে কি, করোনাকালেও আমরা চেষ্টা করেছি সবার কাছে পৌঁছানোর। কিন্তু সব সময় বাড়ি বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রাস্তাঘাটও অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় সবখানে পৌঁছানো কঠিন ছিল।’
অন্য অভিজ্ঞতার কথাও বললেন আটুলিয়া ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা সহকারী নমিতা রানী। তিনি বলেন, কোভিডকালে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে অনেক বাড়িতে তারা ঢুকতেই পারেননি।
সাধারণত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় পিল। এ ছাড়া রয়েছে ইনজেকশন, কনডম, ইমপ্ল্যান্ট, নারী বন্ধ্যাকরণ, পুরুষ বন্ধ্যাকরণ ও আইইউডি।
শুধু গ্রামেই নয়, শহরেও গর্ভপাতের ঊর্ধ্বগতির কথা জানান সংশ্লিষ্টরা। কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, করোনাকালে তারা প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য রোগীর ফোন পেয়েছেন। তারা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের কথা বলে গর্ভপাতের উপায় জানতে চেয়েছেন।’
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বাংলাদেশে গর্ভনিরোধক পিলের ব্যবহার ২০ শতাংশ, কনডমের ব্যবহার ৩৪ শতাংশ এবং ইনজেকশনের ব্যবহার ২৩ শতাংশ কমে যায়। এ ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি আইইউডিসহ (জরায়ুতে স্থাপন উপযোগী অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি গর্ভনিরোধক) ইমপ্লান্ট, এনএসভি (স্ক্যাল্পেল ভ্যাসেকটমি) এবং টিউবেকটমি কমে যায় ২৫-৬৪ শতাংশ।
খুলনার দাকোপ আচাভোয়া বাজার এলাকার বাসিন্দা এক নারী জানান, করোনাকালে তার মুদি দোকানদার স্বামীর ব্যবসা বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল। তখন স্বাস্থ্যকর্মীর দেখা মেলেনি। আবার আর্থিক সংকটের কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম কেনার পরিস্থিতিও ছিল না। তাই গর্ভধারণের পর একটি ক্লিনিকে গিয়ে এমআর (মেন্সট্রুয়াল রেগুলেশন) করিয়ে আসেন তিনি।
ইউনিসেফের কনসালটেন্ট পুলক রাহা বলেন, কোভিডকালে মাঠপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও বিভিন্ন সামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়নি। আবার দোকানপাট বন্ধ থাকায় মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করতে পারছিলেন না। অনেকের সামর্থ্যও ছিল না। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং গর্ভপাত দুটোই বেড়েছে।
বেড়েছে এমএম কিটের ব্যবহারশ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন রীতা রানী পাল বলেন, করোনাকালে অস্বাভাবিকভাবে গর্ভপাত বেড়েছিল, বিশেষ করে লকডাউনের সময়টাতে। তিনি বলেন, ওই সময়ে তিনি এমএম কিটের ব্যবহার ব্যাপক বাড়তে দেখেছেন। গর্ভের বাচ্চার বয়স একটা নির্দিষ্ট সময় (৯ সপ্তাহ) পর্যন্ত এই ওষুধ খেলে স্বাভাবিকভাবে গর্ভপাত হয়ে যায়। কিন্তু এর বেশি সময় পার হওয়ার পর এই ওষুধ খেলে গর্ভের সন্তান মারা গেলেও পুরোপুরি গর্ভপাত হয় না।
চিকিৎসকেরা বলছেন, গর্ভধারণের তিন মাস পার হওয়ার পরও গর্ভপাতের জন্য রোগীরা এমএম কিট খেয়ে থাকেন। এর পরিণতি ভয়ংকর। শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা লতিফা হেলেন বলেন, ‘গর্ভপাতের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রতি ১০ জন রোগীর মধ্যে ৮ জনই এমএম কিট খেয়ে বাচ্চা নষ্ট করে আসেন।’
এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন কর্মী জানান, তিনি করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে অন্তত ৪৮ জন নারীর গর্ভপাত করিয়েছেন।
উপজেলার বংশীপুর ক্লিনিকে ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৩২ জন নারীকে ডিএন্ডসি করানো হয় বলে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল সূত্র। একই সময়ে নগর প্রাইভেট হাসপাতালে অন্তত ৬৫ জনের গর্ভপাত করানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের ৮০ শতাংশ রোগীই নিজেরা ওষুধ কিনে খেয়ে তারপর হাসপাতালের শরণাপন্ন হন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) এবং লাইন ডাইরেক্টর (পিএসএসএম) হুমায়ুন কবীর তালুকদার বলেন, ‘এটা সত্য যে কোভিডকালে পরিবার পরিকল্পনা সরঞ্জাম বিতরণ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তবে পর্যাপ্ত সামগ্রী মজুত ছিল। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের কর্মীদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কর্মীরা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। এ কারণে জন্মনিরোধক বিতরণ কিছুটা ব্যাহত হয়।’