পয়লা বৈশাখের আগে এক সপ্তাহ ধরে প্রতি বছর হালখাতা বিক্রির ধুম থাকলেও এবার সেই ব্যবসায় ধস নেমেছে বরিশালে। নগরীর কাঠপট্টি এলাকায় আগে যেখানে ৩০ থেকে ৩৫ ব্যবসায়ী হালখাতা বিক্রি করতেন, এবার সেখানে আছেন মাত্র দুজন।
বুধবার দুপুরে নগরীর কাঠপট্টি ও বাজার রোড এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দোকান মালিক ও ব্যবসায়ীর মাঝেও এবার হালখাতা করার প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায়নি।
বাজার রোড এলাকার ব্যবসায়ী আবির সাহা বলেন, ‘পয়লা বৈশাখে প্রতি বছরই হালখাতা উৎসব করা হয় আমার দোকানে। নতুন হিসাব খোলা হয় হালখাতায়। কাস্টমাররা এলে তাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। তবে করোনাকালে ব্যবসা ওলটপালট হয়ে গেছে।’
আবির সাহা জানান, ব্যবসায় কয়েক লাখ টাকা বাকি পড়লেও এবার হালখাতা করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন তারা। তাই কিনতে হয়নি হালখাতাও।
একই কথা বলছেন নতুন বাজার এলাকার চকোলেট ব্যবসায়ী সাগর বৈদ্য। এবার হালখাতা না কেনার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘হালখাতায় নতুন হিসাব ওঠানো মানেই উৎসব। আগের বছরের বকেয়া বুঝে পেতেই হালখাতা করা হয়, যা এবার আর করছি না।’
আরেক ব্যবসায়ী স্বপন দাস বলেন, ‘নিয়ম রক্ষার জন্য একটি ছোট হালখাতা কিনেছি। তবে বাজারের যে অবস্থা তাতে বছরের প্রথম দিন কাস্টমারদের আর মিষ্টিমুখ করাতে পারব না।’
কাঠপট্টি এলাকার হালখাতা বিক্রেতা আনিসুর রহমান মিরন বলেন, ‘বছর শুরুর আগে যেখানে হালখাতা কেনার জন্য হুলস্থুল পড়ে যেত, সেখানে এবার কোনো লোকই নেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যবসায়ী হালখাতা কিনেছেন। তাও নিয়ম রক্ষার জন্য।’
বরিশালে এবার মাত্র দুজন খাতা বিক্রি করছেন
মিরন দাবি করেন, করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে পয়লা বৈশাখের আগে যে পরিমাণ হালখাতা আনা হতো, এবার তার এক ভাগও আনা হয়নি।
তিনি জানান, করোনার আগে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ৪ লাখ টাকার হালখাতা বিক্রি করলেও এবার তা লাখে গড়াবে না। আগে বাজারে ৫০ হাজারেরও বেশি হালখাতা বিক্রি হতো। এবার বড়জোর ১৫ হাজার হতে পারে।
এ ছাড়া খাতা তৈরিতে খরচও বেড়েছে। আগে কারিগরদের মজুরি দিতে হতো দৈনিক সাড়ে ৩০০ টাকা, আর এখন দিতে হয় ৬০০ টাকা। তাই এখন যে হালখাতার দাম ১ হাজার টাকা, তা আগে ছিল মাত্র ৫০০ টাকা।
মিরন বলেন, ‘করোনার কারণে মানুষ উৎসবই ভুলে গেছে দেনাগ্রস্ত হয়ে।’
এদিকে পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই ডিজিটাল যুগেও হালখাতা ব্যবহারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন নরদিংদীর ব্যবসায়ীরা। কারণ এই হালখাতার মাধ্যমেই নতুন বছরে ব্যবসাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া চলে।
সরেজমিন নরসিংদী সদর উপজেলায় শিল্প শহর মাধবদী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে নতুন করে তুলেছেন।
চোখে পড়ার মতো ভিড় দেখা গেছে টালিখাতা বা হালখাতার দোকানগুলোয়। এসব দোকানে পুরোনো খাতাগুলো কেউ লাল মোড়কে বাঁধাই করছেন। আবার অনেকে নতুন বছরে হিসাব হালনাগাদ করতে কিনছেন নতুন খাতা।
মুদি ব্যবসায়ী খোকন পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন বছর নতুন করে ব্যবসাকে গুছিয়ে তুলতে একটি মোটা লাল খাতা কিনতে এসেছি। এবার প্রতি খাতার মূল্য ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি। তবুও ব্যবসার খতিয়ানে খাতা ব্যবহারে পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে লাল খাতা কিনলাম।’
নরদিংদীতে ৫০ বছর ধরে হালখাতা বিক্রি করছেন গণি মিয়া
সুতার গদির সরকার সুনীল সাহা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বৈশাখ এলেই হালখাতা পালন করেন মহাজনরা। খাতা কিনতে তাই দোকানে এসেছি। ছয় দিস্তার লালসালু দিয়ে বাঁধানো একটি খাতা কিনলাম ৭৫০ টাকা দিয়ে। এই খাতায় আমাদের ব্যবসার মূল হিসাব রাখা হয়। প্রতিদিন ও মাসিক হিসাবের জন্য আলাদা খাতা আছে। ওই খাতাগুলো এই মোটা খাতায় বাৎসরিক আয়-ব্যয় তুলে রাখা হয়।’
আল-আমিন কালারের ব্যবস্থাপক ফয়েজ আহমেদ জানান, তার রঙের দোকানে প্রতি বছর কয়েক হাজার টাকার খাতা লাগে। এবার হালখাতা পালনের জন্য নতুন খাতা কিনছেন তিনি। একটি বড় লেজার বুকসহ তিনটি হালখাতার অর্ডার দেয়া হয়েছে।
মাধবদী বাজার বড় মসজিদ রোডে খাতা তৈরি করে বিক্রি করছেন ৬৫ বছর বয়সী আবদুল গণি মিয়া। নিউজবাংলাকে তিনি জানান, শৈশবেই বাবার কাছে এই খাতা বাঁধানো শিখেছিলেন তিনি। প্রায় ৫০ বছর ধরে খাতা বিক্রি করছেন তিনি। এ ছাড়া পুরোনো খাতা বাঁধাই করেও মজুরি নেন তিনি।
গণি মিয়া বলেন, ‘এবার করোনা চলে যাওয়ায় খাতার চাহিদা বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে গেছে। আজ চৈত্রের শেষ দিন। তাই ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। দোকানে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা মূল্যের খাতাও রয়েছে। অনেকে ৪-৫ হাজার টাকার খাতাও নেন।’