বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটি বলেছে, দুই বছরের করোনাভাইরাস মহামারি সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর রেখেছে বাংলাদেশ। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্যের আগুনে নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রশংসা করে করোনা মহামারির এই সংকটের সময়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশার কথাও শুনিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আর আগামী অর্থবছরে হতে পারে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস স্প্রিং ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তর থেকে প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষ্যে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে এক সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যান্স টিমার বলেন, ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটছে। করোনার মধ্যেও বাংলাদেশ ভালো করেছে। চলতি অর্থবছরে ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বেশি হবে।’
তবে কিছু ঝুঁকির কথাও বলেছেন তিনি। টিমার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’
প্রতিবেদনে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটি বলছে, কোভিডের কারণে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে তৈরি পোশাক রপ্তানির ধারা এখনো শক্তিশালী। ইউরোপসহ বিভিন্ন বাজারে যদি পোশাক রপ্তানির বর্তমান ইতিবাচক ধারা ধরে রাখা সম্ভব হয়, তাহলে চলতি অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। মূলত আগামী অর্থবছরে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে বলে মনে করে সংস্থাটি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্ট আপডেট’ রিপোর্টেও বিশ্বব্যাংক বলেছিল চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছিল সংস্থাটি।
কয়েক দিন আগে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে উৎপাদন ও সেবা খাতের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কাঙ্খিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধেও (জুলাই-ডিসেম্বর) সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। শেষার্ধেও ওই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
‘তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন ৬ দশমিক ২ শতাংশ। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় মূল্যস্ফীতিই বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞাগুলো বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারস্যাম্য (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স) এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।’
বিশ্বব্যাংক বলেছে, সরকারের ঋণ স্থিতিশীল রয়েছে। গত মার্চ মাসে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যৌথ মূল্যায়নে বলেছে, দেশি-বিদেশি কোনো ঋণেই ঝুঁকিতে নেই বাংলাদেশ।
মহামারি শুরুর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে, যা ছিল তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।
সরকার গত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও মহামারি পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্বলন করা হয়েছিল। অর্থবছর শেষে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ অর্জনের হিসাব দিয়েছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে।
এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অবস্থা
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের প্রবৃদ্ধি হতে পারে সবচেয়ে বেশি ৮ শতাংশ। এরপর মালদ্বীপের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, ভুটানের ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, নেপালের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং পাকিস্তানের হতে পারে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে আফগানিস্তানের জন্য এ বছর প্রবৃদ্ধির কোনো পূর্বাভাস দেয়নি বিশ্বব্যাংক।