সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য ব্যবহৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র-টিএসসিতে মেয়েদের নামাজ পড়ার আলাদা জায়গার দাবিতে যেসব ঘটনা ঘটছে, তার পেছনে কেবল ইবাদতের আকাঙ্ক্ষা নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে, তা নিয়ে এখন আলোচনা তুঙ্গে।
কয়েকজন ছাত্রী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিজেরাই নামাজের জন্য আলাদা জায়গা করেছেন রীতিমতো ঝগড়া করে। এরপর জামাতে নামাজও আদায় করেছেন। সেখানে একজন মেয়ে ইমামতিও করেছেন, যদিও ইসলামে মেয়েদের ইমামতির সুযোগ আছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
আবার কেন মেয়েরা সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য ব্যবহৃত এই স্থাপনাটিতে হঠাৎ আলাদা নামাজের জায়গা করার দাবি তুলছে- এ নিয়ে প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে।
এর কারণ এই কেন্দ্রের রাস্তার উল্টো পাশে রোকেয়া হলেই মেয়েদের নামাজের জন্য স্থান চিহ্নিত আছে। আবার ৩-৪ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ আছে, সেখানে মেয়েদের নামাজের কক্ষটি খুব ছোট হলেও তা বড় করার দাবি ওঠেনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক শিক্ষার্থী, অধিকারকর্মীরা বলছেন, মুসলমানদের পাশাপাশি এই কেন্দ্রে যদি অন্য ধর্মাবলম্বীরাও যদি একই দাবি তুলে সোচ্চার হয়, তাহলে সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে। এতে টিএসসির পরিচয় প্রার্থনাকেন্দ্র হয়ে যাবে।
কেউ কেউ অবশ্য এও বলছেন যে, কেউ যদি তার প্রার্থনা করতে চায় তাহলে ক্ষতির কিছু নেই। ফলে সেখানে নামাজের ব্যবস্থা থাকতেই পারে।
অবশ্য এ বিষয়টি নিয়ে নিউজবাংলা যতজনের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের বেশির ভাগই ‘অতিসংবেদনশীল’ বলে মন্তব্য করতেই রাজি হননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একাধিক অধ্যাপক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও গবেষক, লেখকদের একটি বড় অংশই এ বিষয়ে কথা বলতেই আগ্রহী নন।
টিএসসির উপদেষ্টা সিকদার মনোয়ার মুর্শেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মঙ্গলবার ওরা একটা জায়গা দখল করে সেখানে নামাজের মতন করেছিল। আমরা বলেছিলাম এটা উঠিয়ে নিতে। আমরা প্রশাসনিকভাবে কিছু করব; আমাদের সুযোগ দাও। ওরা আবেদন করেছিল মেয়েদের নামাজ পড়ার জায়গা। টিএসসিতে ওরা যে জায়গাটা করেছে সেটা সুবিধাজনক না।’
‘এখানে নামাজ পড়ার আগ্রহ মুখ্য নয়’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক গাজী নাসির উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, এখানে নামাজ পড়ার আগ্রহটা মুখ্য নয়।
তিনি বলেন, ‘ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয়ের একটা পরিকল্পনা বহু আগে থেকে ছিল। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা জড়ো হচ্ছে সেখানে উপাসনা করতে পারবে না, মানা আছে- এমন কোনো বিষয় নেই কিন্তু কোথাও। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে।’
টিএসসিতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ইস্যুর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘ঘটা করে আয়োজন করে টিএসসিতে কাওয়ালি গাওয়া। হিজাব, নিকাব পরতে কেউ নিষেধ করেনি, রোজার মাসে মানুষের মন যখন আর্দ্র থাকে ধরে নেয়া হয়, এ সময়ে এই জিনিসগুলো তোলাটার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করা উচিত।’
অধিকারকর্মী খুশি কবীর মনে করেন, টিএসসিতে আলাদা করে কোনো ধর্মীয় ব্যবস্থাই রাখা উচিত না। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা শুধু মুসলমানদের জন্য না। সব ছাত্রছাত্রীর জন্য। যারা ধর্ম পালন করতে চায় তারা আলাদা করে নিজের মতন করবে। আমরা যখন পড়েছি, তখন কিন্তু নামাজের জায়গা কারও জন্য ছিল না।’
খুবই কাছে মসজিদ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে কিন্তু নামাজ পড়তে পারেন। আজকাল সব মসজিদে মেয়েদের নামাজের জায়গা আছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন মনে করেন, এই জেদের পেছনের উদ্দেশ্য ইবাদতের আকাঙঙ্ক্ষা হতেই পারে না। তিনি বলেন, ‘ধর্মকে হাতিয়ার করে এরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছে। ধর্মের কার্ড খেলে মূলত জল ঘোলা করে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে।’
‘মৌলবাদী, ধর্মান্ধ সংগঠন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে যারা জড়িত; ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, এই অশুভ শক্তি মিলেই মানুষের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা চলছে। একটা নন-ইস্যুকে ইস্যু করার চেষ্টা করছে। আবাসিক হলে মেয়েদের কমনরুমে নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে।’
অন্য ধর্মের মানুষরাও যদি প্রার্থনাকেন্দ্রের দাবি তোলে?
মুসলমানদের মতো অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এখন টিএসসিতে প্রার্থনার জন্য জেদ করতে পারে বলেও মনে করেন গাজি নাসির। বলেন, ‘জনসংখ্যায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের যে অনুপাত, তার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এদের শিক্ষার অংশগ্রহণ বেশি। সেই হিসেবে যদি নিজেদের গোষ্ঠী দাবি করে তারাও যদি উপাসনা করার প্রার্থনা করতে চায়?’
‘এ বিষয়টিকে প্রশ্রয় দিলে পরে সামাল দেয়া কঠিন হবে। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটা সমস্যা সৃষ্টি করে বাকি সমস্যাগুলোকে ইনভাইট করল, সেগুলো তারা সমাধান করবে কীভাবে? এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ না আর এসব বিষয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকাস নষ্ট হয়ে যায়।’
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ছাত্রছাত্রীরা যদি টিএসসিতে তাদের উপাসনার জায়গা চায় সে ক্ষেত্রে কী করবেন, এমন প্রশ্নে টিএসসির উপদেষ্টা সিকদার মনোয়ার মুর্শেদ বলেন, ‘তারা আবেদন করুক। তারপর আমরা দেখব। সকলের অধিকার আছে সকল মানুষের।’
তখন টিএসসির মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গা থাকা উচিত। টিএসসিকে এমনভাবে রাখা উচিত যাতে করে তার মূল উদ্দেশ্য অব্যাহত থাকে। আসলে মসজিদে প্রার্থনা করা উচিত।’
তবে সব উচিত বাংলাদেশের বাস্তবতায় হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টিএসসিকে এর বাইরে রাখা দরকার।’
ধর্মীয় বিষয়, সহনশীলতার সঙ্গে দেখার পরামর্শ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মাদ মাহবুব কায়সার অবশ্য মনে করেন টিএসসিতে নামাজের আলাদা জায়গা থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে মারামারি ঝগড়ার কী আছে? সব ভবনেই নামাজের আয়োজন আছে। সেন্ট্রাল মসজিদ আছে। হলে হলে মসজিদ আছে।’
টিএসসিতে অনেক লোকসমাগম হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেই বিবেচনায় নামাজের আয়োজন থাকতে পারে। যে নামাজ পড়ল, সে পড়বে।’
নামাজকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সে বিবেচনায় মসজিদ না হলেও এখানে প্রার্থনার কক্ষ থাকতে পারে। এটা ধর্মীয় বিষয়, সহনশীলভাবে দেখতে হবে।’
টিএসসির কাঠামো পাল্টালে মানব না: নুর
টিএসসিতে মেয়েদের জন্য নামাজের আলাদা জায়গা করার জন্য যে চেষ্টা, তাকে সহযোগিতা করেছে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন করে আলোচিত সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ।
এই পরিষদের সাবেক নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিএসসিতে ছেলেদের জন্য নামাজের জায়গা আগে থেকে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেয়েরা তার সামনে খালি জায়গাটাকে ব্যবস্থা করেছে।’
অন্যান্য ধর্মের শিক্ষার্থীরা যদি টিএসসিতে এসে প্রার্থনা করতে চায়?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মুসলমান শিক্ষার্থী যদি টিএসসির অবকাঠামো পরিবর্তন করে নতুন কাঠামো বানাতে চায়, সেটা যেই হোক আমরা তাতে সাপোর্ট করব না। বিদ্যমান কাঠোমোয় কেউ যদি তার ধর্মীয় প্রার্থনা করতে চায় করুক না।’
এর পেছনে রাজনীতি আছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নামাজের জায়গার দাবির পরই ছাত্রলীগ বলল, মোল্লাতন্ত্রের কবর রচনা করবে। প্রশাসনের জায়গা থেকে সহিংসতা ঘটানোর জন্য এটা করা হচ্ছে।’