পুরোনো দিনের গ্লানি ভুলে পয়লা বৈশাখের অনুপ্রেরণায় সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা ছেড়ে উদার জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে, বৈষম্যহীন, ধর্মে ধর্মে বিভেদ ছাড়া সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলতেও সবার সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে তিনি এ আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পয়লা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। মনের ভেতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার শক্তি জোগায়, স্বপ্ন দেখায়।
‘আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।’
দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এ ভূখণ্ডের হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির বাহক এ দেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী। বিভিন্ন ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত হলেও ঐতিহ্য ও কৃষ্টির জায়গায় সব বাঙালি এক এবং অভিন্ন।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘১৪২৯ বঙ্গাব্দের শুভ মুহূর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় স্নাত হয়ে আসুন বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলি, যেখানে বৈষম্য থাকবে না, মানুষে মানুষে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ, থাকবে না ধর্মে ধর্মে কোনো বিভেদ।
‘পারস্পরিক সৌহার্দ্য আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আসুন বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি।’
পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা নতুন বছর উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরেনানা ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন এখনও স্বমহিমায় টিকে আছে বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘সারা বছরের ক্লেদ-গ্লানি, হতাশা ভুলে এদিন সব বাঙালি নতুন আনন্দ-উদ্দীপনায় মেতে ওঠেন।’
পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আবহমানকাল ধরে বাংলার গ্রামগঞ্জে, আনাচে-কানাচে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন ছিল বর্ষবরণের মূল অনুষঙ্গ।
‘ব্যবসায়ীরা আগের বছরের দেনা-পাওনা আদায়ের জন্য আয়োজন করতেন হালখাতা উৎসবের। গ্রামীণ পরিবারগুলো মেলা থেকে সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র কিনে রাখতেন। গৃহস্থ বাড়িতে রান্না হতো সাধ্যমতো উন্নত মানের খাবার।’
বিশ্বের যেখানে বাঙালি আছে, সেখানেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন হয় বলেও জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘বর্ষবরণসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তারা জানান দেন তারা বাঙালি। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবীজুড়ে তৈরি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির সেতুবন্ধ।’
করোনায় দুই বছর উৎসব না হওয়ায় আক্ষেপ, সতর্ক থাকার তাগিদ
করোনাভাইরাসের কারণে বিগত দুই বছর জনসমাগমের মাধ্যমে খোলা জায়গায় পয়লা বৈশাখের আয়োজন না হওয়ায় আক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। তাই এবার সীমিত আকারে হলেও বহিরাঙ্গনে অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে।’
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও একেবারে নির্মূল হয়নি বলে সবাইকে সতর্ক করেছেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘নতুন রূপে করোনাভাইরাস আবার যেকোনো সময় যেকোনো দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এসব অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
তবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ টিকা পাওয়ার যোগ্য মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের পর এখন বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে।’
দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করা সরকারের দায়িত্ব জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যতদিন বেঁচে আছি, মহান রাব্বুল আলামিন আমাকে কাজ করার সামর্থ্য দেবেন, ততদিন মানুষের জন্য কাজ করে যাব, জনগণের সেবা করে যাব।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় প্রধানমন্ত্রী শোনান:
জীবনের এই পথ, কে বলিতে পারে
বাকি আছে কত?
মাঝে কত বিঘ্নশোক, কত ক্ষুরধারে
হৃদয়ের ক্ষত?
পুনর্বার কালি হতে চলিব সে তপ্ত পথে,
ক্ষমা করো আজিকার মতো--
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।