বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি ‘টমটম’ গাড়ি নিয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় এসেছেন খোরশেদ মিয়া। বৈশাখের এই সময়টাতে চাহিদা বাড়ে; বিক্রি করে বড় অংকের আয় হয়।
খোরশেদ শুধু টমটম নয়, নিয়ে এসেছেন মাটির টেপা পুতুল, কাগজের মুখোশ ইত্যাদি। কিন্তু এবার আশানুরূপ বিক্রি নেই। বলছেন, করোনায় দুই বছর ব্যবসা হয়নি। এবার রোজা।
বৈশাখকেন্দ্রিক এসব খেলনা ও অন্যান্য উপকরণ বিক্রিতে অন্য বছরের মতো সাড়া না থাকলেও গেল দুই বছরের মতো হাহাকার নেই।
রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দোয়েল চত্বর, গুলিস্তান, পুরান ঢাকা ঘুরে এমন তথ্য মিলেছে।
বৈশাখ এলেই নাগরিক মানুষের চাহিদায় থাকে মাটির তৈরি নান্দনিক হাঁড়ি-পাতিল। এ ছাড়া কাগজের মুখোশ, খেলনা, বাঁশি বিক্রিও হয় দেদার। বলা হয় এগুলো বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
নতুন বছরকে বরণ করে নিতে চলছে জোর প্রস্তুতি। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
এ ছাড়া মাটি ও কাঠের তৈরি পুতুল, টিয়া পাখি, সিংহ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মাছ, মুরগি, হাঁস ও হাতিসহ নানান পণ্যের চাহিদা থাকে ভালো। কিন্তু এবার করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রিত হলেও, রোজার কারণে চাহিদা তেমন নেই।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী পণ্য সাজিয়েছেন দোকানিরা।
সরেজমিনে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দোয়েল চত্বর, গুলিস্তান, পুরান ঢাকার চকবাজার ঘুরে দেখা যায়, নববর্ষ উদযাপনে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুত। তবে অধিকাংশ দোকানে বিগত দুই বছরের জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখা। নতুন করে পণ্য তোলেননি ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ২০২০ আর ২০২১ সালে করোনার কারণে বৈশাখ পালন হয়নি। ফলে বৈশাখ উপলক্ষে আনা পণ্য অবিক্রিতই রয়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরে বসেছে কুলা, সাজি, চালন, ধামা, একতারা, দোতারা, পালি, বাঁশি, ঢেঁকি, বাঁশের কুলা, ডালা, পাখা, বিভিন্ন মাটির হাড়িতে বৈশাখ লেখা ও সুন্দর ডিজাইন করা মাটির জিনিসপত্রের পসরা।
দোয়েল চত্বরের দোকানি মো. আওলাদ হোসেন বলেন, ‘প্রস্তুতি তেমন একটা নাই। আগের (দুই বছর) মালের সঙ্গে নতুন কিছু মাল মিলিয়ে বিক্রি করছি। এবার রমজানের ভেতরে পয়লা বৈশাখ পড়ছে, তাই ওভাবে প্রস্তুতি নাই। রমজান মাসের কারণে বৈশাখ সেইভাবে পালন হবে না, তাই প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল না। দুই একজন টুকটাক কিনছে, তবে ওভাবে বেচাকেনা দেখা যাচ্ছে না এবার।’
বৈশাখ বরণের জিনিসপত্র কিনতে রাজধানীর দোয়েল চত্ত্বরে এক ক্রেতা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
তিনি আরও বলেন, ‘দুই-তিন বছর আগে যে বৈশাখ হইছে, তার সঙ্গে এহনের বৈশাখ রাত-দিন পার্থক্য। আগে এক মাস আগে বৈশাখের মালের অর্ডার থাকত। এ বছর সেটা নাই। এখন যে মাল আছে, সেগুলা কোনোমতে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য বছর বিভিন্ন বড় অফিসের যে অর্ডার থাকত, এ বছর সেরকম অর্ডার নাই। এবার ফ্যামিলির জন্য অল্প করে পণ্য কিনছে। এটা মূলত রমজানের কারণেই হচ্ছে। গত দুই বছর করোনার কারণে বৈশাখ পালন হয় নাই। এবার করোনা ভালো হলেও রমজানের কারণে বৈশাখের ব্যবসা ধরা।’
ডিজাইন করা মাটির হাড়ি কিনতে আসা নুসরাত জাহান বলেন, ‘বৈশাখে মাটির তৈরি পণ্য বাঙালির ঐতিহ্য। এ ছাড়াও আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, এসব পণ্য স্বাস্থ্যসম্মত। তাই মেয়ের খেলনার পাশাপাশি কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্রও কিনব।’
গত ১০ বছর ধরে বৈশাখী পণ্য বিক্রি করেন ব্যবসায়ী সাইদুল হাসান সুমন। তিনি বলেন, ‘এবার ব্যবসা ১০ শতাংশও নাই। দুই বছর আগে এই সময়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থাকত না বিক্রির চাপে। এবার দেখেন একদম ফাঁকা। গত দুই বছর লকডাউন ছিল। এবার রোজার কারণে বৈশাখের অর্ডার ও কাস্টোমার নেই। গত ১০ বছরে এমন খারাপ ব্যবসা হয়নি।’
অফিসে সাজাতে চালন, বাঁশ, কুলা, বেত ও মাটির পসরা কিনতে এসেছেন সেলিনা বেগম। সঙ্গে রয়েছেন তার সহকর্মী আরিফুর রহমান। তারা বলেন, এবার রমজানের কারণে খুব ছোট পরিসরে অফিসে বৈশাখ উদযাপন করা হবে। এ জন্য অফিস সাজানোর জন্য কিছু লোকজ জিনিস কিনতে এসেছেন তারা।
বৈশাখে একতারা হাজার হাজার পিস বিক্রি হয়। এ বছর তেমন বিক্রি নাই। আক্ষেপের সুরে এমন কথা জানান ব্যবসায়ী মো. জামাল হোসেন। বলেন, ‘বৈশাখের এসব মাল ঢাকায় তৈরি হয় না। কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও বরিশাল থেকে এই মাল কিনে আনি। অন্য বছরের তুলনায় এবার দাম একটু বেশি। আমাদেরই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। কারণ কারিগরের বেতন দিতে হয় বেশি। আগে যে জিনিস ৬০ টাকা ছিল, এখন সেটার দাম হয়েছে ৭৫ টাকা। কিন্তু বেচা-কেনা নেই।’
তবে গত দুই বছরের তুলনায় বেচাকেনা কিছুটা ভালো বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
একই চিত্র দেখা গেছে পুরান ঢাকাতেও।
বৈশাখ বরণের পণ্য দেখছেন এক ক্রেতা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
দোকানগুলোতে নববর্ষের তেমন কোনো সরঞ্জামের দেখা মেলেনি। দুই একটা দোকানে নববর্ষের কার্ড, একতারা, টমটম গাড়ি, ডুগডুগি, কুলা, পাখা, মুখোশ, মাটির পুতুল, পাখা, ঘুড়িসহ নানান জিনিস দেখা গেছে।
বেচাকেনা প্রসঙ্গে চকবাজারের দোকানি আওলাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে পাইকারি বিক্রি বেশি। সাধারণ বৈশাখের এক মাস আগে বিভিন্ন জিনিসপত্রের অর্ডার পাই আমরা। কিন্তু এবার সেভাবে হয়নি। তবে গত দুই বছরের তুলনায় টুকটাক বেচাকেনা হচ্ছে।’
একই এলাকার ব্যবসায়ী লিয়াকত মিয়া বলেন, ‘করোনার আগে বেচাকেনা অনেক ভালো ছিল। করোনার দুই বছরে বৈশাখের জিনিসপত্র ডুগডুগি, ভুভুজেলা, বাঁশি একেবারে বেচাকেনা হয়নি। এবার বৈশাখ পড়েছে রোজার মধ্যে। ফলে সামান্য খুচরা কিছু বিক্রি হয়েছে। তরুণ-তরুণীরা কিছু জিনিসপত্র কিনছে। বড় বড় পাইকারি অর্ডার নেই বললেই চলে।’