ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) মেয়েদের জন্য আলাদা নামাজের জায়গা করা নিয়ে নানা ঘটনার মধ্যে কিছু মেয়ের সেখানে রাখা কার্পেট ও পর্দা কে বা কারা সরিয়ে নিয়েছে।
মঙ্গলবার রাতের কোনো এক সময় এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে টিএসসির নিরাপত্তা কর্মী বলতে পারছেন না, কারা তা সরিয়েছে।
টিএসসি সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকলেও গত রাতে ক্যামেরা বন্ধ ছিল বলে জানিয়েছেন একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা।
ছাত্রীদের তৈরি করা নামাজের সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলার পর ছেলেদের নামাজের গেটেও তালা লাগিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে ছেলেদের নামাজের স্থানের কার্পেটগুলো জায়গা মতোই আছে।
গত কয়েকদিন ধরেই টিএসসিতে নামাজের জন্য আলাদা জায়গা করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন কয়েকজন ছাত্রী। কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেয়ার পর মঙ্গলবার তারা নিজেরাই সেখানে ‘নামাজের আলাদা’ জায়গা বানিয়ে ফেলে। সেখানে কর্তৃপক্ষ এসে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেয়ার অনুরোধ করলেও তারা কথা শোনেনি।
সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য ব্যবহৃত এই স্থাপনাটিতে হঠাৎ আলাদা নামাজের জায়গা করার দাবি কেন উঠছে- এ নিয়েও তর্ক বিতর্ক চলছে। এই কেন্দ্রের রাস্তার উল্টা পাশে রোকেয়া হলেই মেয়েদের নামাজের জন্য স্থান চিহ্নিত আছে।
আবার তিন থেকে চার মিনিটের হাঁটা দূরত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ আছে, সেখানে মেয়েদের নামাজের জায়গাটি একেবারে সংকীর্ণ, সেটি বড় করার জন্য কোনো দাবি তোলা হয়নি। এ কারণে টিএসসিকেন্দ্রিক এই দাবির পেছনে কেবল নামাজ আদায় নাকি অন্য উদ্দেশ্য আছে-তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এর পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ফেসবুক গ্রুপ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে নানা বক্তব্য রাখছেন। মুসলমানদের পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরাও যদি কেন্দ্রটিতে প্রার্থনার জন্য আলাদা জায়গা দাবি করে- তাহলে এই কেন্দ্রটির চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখা যাবে কি না-এই প্রশ্নও উঠছে।
এই বিতর্কের মধ্যেই মেয়েদের নামাজের স্থানের ব্যবস্থা করতে সহযোগিতা করেছে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন করে আলোচিত সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ।
২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই মেয়েদের নামাজের জন্য চিহ্নিত জায়গা থেকে সরঞ্জাম সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাহিত্য সম্পাদক জাহিদ আহসান বলেন, ‘আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এটির মাধ্যমে মেয়েদের অধিকার হরণ করা হয়েছে।আমরা চাইব না মেয়েদের অধিকার হরণ করার মতো ঘটনাগুলো ঘটুক।’
কাউকে সন্দেহ করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে সিসিটিভির ফুটেজ না দেখে কাউকে ঢালাওভাবে সন্দেহ করা সমীচীন হবে না।
‘আমরা এই ঘটনা টিএসসির পরিচালক আকবর (আলি আকবর) ভাইকে জানিয়েছি। উনাকে বলেছি সিসিটিভির ফুটেজ দেখানোর জন্য। তিনি জানিয়েছেন, সিসিটিভি বন্ধ ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে মঙ্গলবার একদল ছাত্রীর নামাজ আদায়। ছবি: নিউজবাংলা
সার্বিক বিষয়ে টিএসসির উপদেষ্টা অধ্যাপক মনোয়ার মোর্শেদ এবং টিএসসি পরিচালক সৈয়দ আলী আকবরকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তারা ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিএসসির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনাটা আমিও শুনেছি। টিএসসির গেটম্যানদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, তারাও কিছু জানে না। সকালে নামাজ পড়তে এসে দেখে এই অবস্থা।’
সিসিটিভি ফুটেজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এর আগে মঙ্গলবার টিএসসিতে নামাজের স্থান তৈরির দাবি তোলার কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে আলাদা স্থান করে জোহরের নামাজ আদায় করে একদল ছাত্রী।
দুপুরে টিএসসিতে আগে থেকে থাকা ছেলেদের নামাজের স্থানের সামনে পর্দা টানিয়ে এর সামনের খালি জায়গায় মেয়েদের স্থান তৈরি করেন তারা।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন টিএসসির উপদেষ্টা অধ্যাপক শিকদার মনোয়ার মোর্শেদ, পরিচালক সৈয়দ আলী আকবরসহ অন্য কর্মকর্তারা।
তারা মেয়েদের নামাজের স্থান নির্মাণ করা হয়নি জানালে শুরু হয় বাগ-বিতণ্ডা। এরপর আগামী ২২ এপ্রিলের মধ্যে মেয়েদের নামাজের স্থান তৈরির আশ্বাস দিয়ে মেয়েদের তৈরি করা স্থান সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ করেন মনোয়ার মোর্শেদ। এতেও মেয়েদের রাজি করানো যায়নি। পরে সেই স্থানেই নামাজ আদায় করেন তারা।
শিক্ষার্থীদের দাবি, ২২ এপ্রিলের মধ্যে টিএসসিতে মেয়েদের নামাজের স্থান বানানো হবে- সেটার লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং এর আগ পর্যন্ত তারা তৈরি করা স্থানেই নামাজ আদায় করবেন।
গত ৫ এপ্রিল দুপুরে টিএসসিতে নামাজের স্থান বরাদ্দের দাবি জানিয়ে উপাচার্য বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন কয়েকজন ছাত্রী। উপাচার্য দাবিটিকে ‘ভালো’ দাবি বলেও উল্লেখ করেন।
এরপর টিএসসিতে নামাজের স্থানের দাবিকে ধর্মান্ধ-প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপতৎপরতা দাবি করে গত ৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্রলীগ।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘মোল্লাতন্ত্রের বলি হওয়ার জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিনি; মোল্লাতন্ত্রের কবর রচনার জন্যই আমাদের আসা।’
তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও তাঁবেদার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান।