নারায়ণগঞ্জ শহরের অলিগলিতে একটি খালি রিকশা নিয়ে ছুটছেন ইদ্রিস আলী। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী কোনো মেয়ে দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন, মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। নিজের রিকশায় বসে হাউমাউ করে কাঁদছেনও। রাস্তায় থাকা লোকজন এগিয়ে এলেই হাতে থাকা দুটি ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আমার মাইয়া দুইডারে দেখছেননি।’
বুধবার নগরীর কলেজ রোড এলাকায় রিকশায় বসে কাঁদছিলেন ইদ্রিস। জানতে চাইলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ করে বলতে থাকেন, ‘আমার কলিজা দুইডা হারায় গেছে ভাই, ওগো খুঁজতে শহরে আইসি, পাইতাছি না।’
কান্না করতে করতে রিকশার সিটের নিচ থেকে দুই মেয়ে ৯ বছরের ইতি ও ৫ বছরের মীমের দুটি ছবি বের করেন। গলায় জড়ানো ঘামে ভেজা গামছা দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরেও কান্না থামছিল না তার। যেন জীবনের সব হারিয়ে নিস্ব এক বাবা নিজেকে আর কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারছেন না।
তবুও নিজের সব হারানোর গল্প বললেন দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার কৃষক ইদ্রিস আলী। মেয়েদের খুঁজতে এসে নারায়ণগঞ্জ শহরে যার পরিচয় এখন ‘রিকশাওয়ালা’।
ইদ্রিসের স্ত্রী শাহানাজ আর দুই মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল ইদ্রিসের। কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। বছরখানেক আগে গ্রামের এক দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশ যেতে বেকুল হয়ে ওঠেন তার স্ত্রী। তবে তাতে রাজি ছিলেন না ইদ্রিস। এক দিন গ্রামের বাজার থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন দুই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছেন স্ত্রী। তারপর আর খোঁজ মেলেনি তাদের। তাদের খুঁজতেই শহরের পাড়া-মহল্লায় ছুটছেন আর কাঁদছেন। অপেক্ষায় কখন দেখবেন প্রিয় সন্তানদের মুখ।
দুই সপ্তাহ হলো নারায়ণগঞ্জ শহরে এসেছেন ইদ্রিস। ৬৮৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জেলায় হারানো দুই মেয়েকে কোথায় খুঁজবেন, কীভাবে খুঁজবেন তা ভেবেই বেছে নিয়েছেন রিকশা। খাওয়ার খরচ আর রিকশার জমার টাকা উঠিয়ে বাকি সময় খালি রিকশা নিয়ে ছুটছেন। অর্ধকোটি মানুষের এ শহরে কোন জাদুকর তার মেয়েদের খোঁজ দেবে জানেন না ইদ্রিস।
নিউজবাংলাকে ইদ্রিস আলী বলেন, ‘গেরামে (গ্রামে) আমি চাষাবাদ করতাম। ভালোই ছিলাম। যখন গেরামে কাম থাকত না, তখন শহরের আইসা রাজমিস্ত্রির কাম করতাম। তারপরও বউ বেটিগো কষ্ট করতে দেই নাই। আমার বড় মেয়েডা গ্রামের স্কুলে ক্লাস টুতে (দ্বিতীয় শ্রেণি) পড়ত। ছোট মেয়েডা এই বছর ভর্তি করতাম। আমার কপাল খারাপ, তাই আমার মেয়ে দুইডা আমার কাছে নাই। আমার মেয়ে দুইডারে পাইলে ওগোরে গ্রামে নিয়া স্কুলে ভর্তি করামো। আমার স্বপ্ন সত্যি করমো, ওগো অনেক পড়ালেখা করামো।’
মেয়েদের কীভাবে হারালেন জিজ্ঞেস করতেই বলতে থাকলেন, ‘প্রায় ১ বছর আগে গেরামের এক দালালের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার স্ত্রীর। এরপর থেকে সে বিদেশ যাওয়ার জন্য বারবার বলতে থাকে। সেখানে গেলে নাকি অনেক টাকা কামাইব। আমি রাজি ছিলাম না। আমি তারে বলছিলাম, আমরা গ্রামে ভালোই আছি। দরকার হইলে আমি আরও কষ্ট করমো তাও জাবার পারবা না। কিন্তু শুনে নাই, শাহনাজ আমার কথা শুনে নাই।
‘ওই দিন রাইত ৮টা বাজে আমি বাজার থ্যাইকা বাড়িতে গিয়া দেখি আমার বউ আর মাইয়া দুইডা ঘরে নাই। সারা গ্রাম তাগো খুঁজছি, তাও পাই নাই। পরে দিনাজপুর শহরে খুঁজছি, সেখানে পাই নাই। গ্রামের এক লোক তখন বলছিল ঢাকা খুঁজতে, পরে ঢাকা আইসা তিন মাস বিল্ডিংয়ের কাম করছি আর খুঁজছি, কিন্তু পাই নাই। এরপর গাজীপুরে গিয়াও খুঁজছি আরও ১ মাস। এমনে কইরা অনেক মাস পার করছি, তাও পাই নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০ থেকে ২২ দিন আগে আমার শাশুড়ি ফোন করছিল। তখন বলতাছিল আমার মাইয়ারা আমার সঙ্গে কথা কইব। তহন আমার অনেক ভালা লাগতাছিল। এরপর বড়ডারে ফোন দিলে মাইডা কয়, আব্বা আমাগো লইয়া যান, আমরা বাড়িত যামো। তহনি শাশুড়ি ফোন নিয়া নেয়। আমি জিজ্ঞাইলাম ইতির মা কই। কিছুই কইল না। জিজ্ঞাইলাম আমনেরা কই আছেন, কইল পঞ্চবটি। এরপর ফোন রাইখা দিছে। আমি অনেকবার ফোন করছি খালি বন্ধ কয়।’
মেয়েদের কথা মনে করে আবার কাঁদতে শুরু করেন ইদ্রিস। কিছুটা স্থির হয়ে এই শহরে আসার গল্প বলতে থাকলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ শহরে আসমো টেকা আছিল না। মাইনসের খেতে ৩০০ টেকা রোজে কাম কইরা টেকা ম্যানেজ কইরা আইছি। নারায়ণগঞ্জে আইসা পঞ্চবটিতে খুঁজছি, কিন্তু পাই নাই। সেখান থেকে মুসলিম নগর নামে একটা গ্রামের দিকে যাইতাছিলাম তখন রাস্তায় আমাগো গ্রামের আনোয়ারের সঙ্গে দেখা হইছে। সে রিকশা চালায় যাইতাছিল। এরপর ওয় আমারে মাসদাইর গ্যারেজে নিয়া গেছে। সেখানে আরও অনেক রিকশাওয়ালা আছিল। তারা কইল রিকশা নিয়া মাইডারে খুঁজতে থাক, আল্লায় ভাইগ্যে রাখলে পাইয়া যামো। তারপর থ্যাইকা রিকশা চালাই।
‘আমি অনেক সময় যাত্রীগো কাছ থ্যাইকা ভাড়াও নেই না। ছবি দুইটা দেখাইয়া বলি, আমার মাইয়া দুইডারে দেখলে আমার গ্যারেজে খবর দিতে। জানি না, আমার মেয়েগো নিয়া বাড়ি ফিরতে পারমু কি না।’
থানায় অভিযোগ করেছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমাগো গ্রামের চেয়ারম্যান কইছিল অপেক্ষা করো, আইসা পড়বোনে। আমি থানা পুলিশ বুঝি না, তাই যাই নাই। তবে নারায়ণগঞ্জে একটা জিডি করছি।’
ইদ্রিসের ঘটনার বিষয়ে জানতে দিনাজপুরে তার বড় ভাই হবিবর আলীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ভাইডা সবাইরে নিয়া ভালোই আছিল, কিন্তু ওর বউডা বুঝল না। গ্রামে থাকতে ২০ হাজার টাকা দিয়া টেডিং (ট্রেনিং) দিসে। হঠাৎ এক দিন শুনি মেয়ে দুইডা লইয়া চলে গেছে।’
ইদ্রিসের এলাকার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুমন চন্দ দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ইদ্রিস ভাইরে আমি চিনি। ওর বউ তো মেয়ে দুইডা নিয়া গ্রাম থ্যাইকা চলে গেছে। গ্রামের লোকেদের কাছে শুনছি, বিদেশ গেছে। শুনছি ইদ্রিস ভাইয়ে ঢাকা গেছে। ইদ্রিসও নাহি তাগো খুঁজতে ঢাকা গেছে।’
কাহালোর উপজেলার ৩ নম্বর মুকুন্দপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম ফারুক হোসেনের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এদিকে মঙ্গলবার রাতে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন ইদ্রিস। সেখানে একই ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আবেদন জানিয়েছেন দুই মেয়েকে খুঁজে দিতে।
ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুজ্জামান নিউবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমলে নিয়ে পুলিশ ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছেন। তার মেয়েদের খুঁজে পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইদ্রিসকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। তার মেয়েরা যদি নারায়ণগঞ্জে থাকে, তাদের খুঁজে বের করা হবে।’