গরমে প্রশান্তি পেতে দীর্ঘকাল ধরে হাতপাখার ব্যবহার হয়ে আসছে দেশে। কালের বিবর্তনে বৈদ্যুতিক পাখা সে স্থান দখল করে নিলেও বিলীন হয়ে যায়নি পাতার পাখা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে হাতপাখাকে টিকিয়ে রেখেছেন কারিগররা। তাদের একজন সজেত শেখ।
খুলনা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা গ্রামে বাড়ি সজেতের। হাতপাখার এই নিখুঁত কারিগরের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় নিউজবাংলার।
হাতপাখায় হাতেখড়ি নিয়ে সজেত বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৬৬ বছর। ৯ বছর বয়স থেকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি হাতপাখা তৈরি। ছোটবেলায় বাড়ির আঙিনা থেকে তালগাছের পাতা কেটে নিজেই জাগ দিতাম।
‘সেই পাতা থেকে পাখা তৈরি করতাম। ১০০ পিস পাখা তৈরি হলে হেঁটে খুলনা শহরে যেতাম। সেখানে পাইকারি দোকানে পাখা বিক্রি করতাম। সেই সময়ে ১০০ পিস পাখার দাম ছিল ৪ টাকা।’
তিনি বলেন, ‘তখন প্রচুর চাহিদা ছিল। গ্রাম-শহরের কোনো বাড়ি বাদ ছিল না, যেখানে তালপাতার হাতপাখা ব্যবহার হতো না। তখন আমাদের গ্রামের শত শত মানুষ এই পাখা বানাত।
‘এখন সবাই বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করেন। তাই বাজারে হাতপাখার চাহিদা কমেছে। এতে আমাদের গ্রামের প্রায় সবাই পেশা পরিবর্তন করেছেন, তবে আমি আগলে রেখেছি পেশাটাকে।’
পাখা তৈরির খরচ ও বিক্রি নিয়ে সজেত বলেন, ‘এখন আর আমাকে শহরের দোকানে দোকানে গিয়ে পাখা দিয়ে আসতে হয় না। পাইকারি দরে কয়েকজন দোকানদার আমার বাড়ি থেকে পাখা কিনে নিয়ে যান। প্রতি ১০০ পিস পাখা এখন পাইকারি দরে বিক্রি করি ২ হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা।’
তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণত দুই ধরনের হাতপাখা বানাই। এক ধরনের পাখায় তালগাছের ডাটা (হাতল) থাকে, এটির দাম বেশি। এর ১০০ পিসের পাইকারি দাম ২৫০০ টাকা। এ ছাড়া আরেক ধরনের পাখায় তালগাছের ডাটা থাকে না। সেখানে বাঁশের চটা বাঁধা হয়। এ ধরনের পাখার দাম কিছুটা কম। সাধারণত প্রতি ১০০ পিস পাখা পাইকারি দরে বিক্রি হয় ২ হাজার টাকা।
‘আমার ১০০ পিস তালপাতার হাতপাখা তৈরি করতে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে ৬০০ টাকা দিয়ে ১০০ পিস কচি তালপাতা কিনতে হয়। এ ছাড়া একটি ছোট বাঁশ কিনতে হয় ১০০ টাকা দিয়ে। গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে কেনা তালপাতা বাড়ি আনতে খরচ হয় ১০০ টাকা।’
তিনি জানান, বছরের প্রায় ৯ মাস বাজারে কম-বেশি তালপাতার হাতপাখার চাহিদা থাকে, তবে শীতের তিন মাস কেউ এই পাখা কিনতে চান না।
শীতের তিন মাস বাঁশের ঝুড়ি তৈরি করেন সজেত। এই হাতপাখা তৈরিতে কেমন সময় লাগে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিন দিনে আমি ১০০ পিস পাখা তৈরি করতে পারি। প্রথম দিন কচি তাল পাতা কিনে বাড়িতে এনে জাগ দিই। পরের দিন পাতা কেটে পাখার আকার দিই। শেষ দিন ওই পাতায় বাঁশের রঙিন শলা বাঁধলেই পূর্ণাঙ্গ পাখা তৈরি হয়ে যায়।’
স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলেই সজেত শেখের সংসার। তাদের একমাত্র ছেলে সাহেদুল শেখ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন আলাদা সংসারে।
সজেত শেখের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ৫০ বছর আগে। অভাবের সংসারে কখনও আমার স্বামীকে পেশা পরিবর্তন করাতে পারিনি। এখন তাকে আর পেশা পরিবর্তন করতে বলি না। আমি নিজেই তার পাখা তৈরির সব কাজে সাহায্য করি।’
সজেত শেখের কাছ থেকে প্রায় ১০ বছর ধরে পাইকারি দরে পাখা কিনেন সুকুমার জোয়ারদার।
তিনি বলেন, ‘ডুমুরিয়া বাজারে আমার একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি ও মেরামত করা হয়। দোকানে অনেকেই ইলেকট্রিক ফ্যান মেরামত করতে আসেন। ফ্যানটি মেরামত করতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। ওই সময়টুকুর জন্য আমি তাদের হাতপাখা কিনে নিয়ে যেতে বলি।
‘এ ছাড়া অনেকে আবার শখ করে হাতপাখা কেনেন। আবার কেউ কেউ মাঠে কৃষিকাজ করার সময়ে হাতপাখা রাখেন। তাদের অনেকেই আমার কাছ থেকে পাখা কেনেন। আমি প্রতিটি তালপাতার হাতপাখা ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি করি।’
সজেত শেখের কাছ থেকে পাইকারি দরে হাতপাখা কিনে থাকেন খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে অবস্থিত কয়েকজন মুদি দোকানি।
মুদি দোকানি আবু হানিফ বলেন, ‘হাসপাতালে অনেক রোগী আসে। অনেক সময়ে তাদের বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। সেখানে বৈদ্যুতিক পাখা থাকে না।
‘তারা সাধারণ হাতপাখা কিনে থাকেন। এ ছাড়া কিছু রোগীর গায়ে ইলেকট্রিক পাখার বাতাস দেয়া যায় না। তারাও হাতপাখার বাতাস নিয়ে থাকেন।’
খুলনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, ‘সাধারণত শ্বাসকষ্টে থাকা কিছু রোগীকে চিকিৎসকরা বৈদ্যুতিক পাখার বাতাস নিতে নিষেধ করেন। সেসব রোগীরা হাতপাখা ব্যবহার করেন।’